আজ ১লা ফাল্গুন ১৪২৮, ইংরেজি ১৪ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাজবংশী জনজাতির প্রাণপুরুষ রায় সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার আবির্ভাব দিবস। ইতিমধ্যে সময়ের স্রোতে এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম সার্ধশতবর্ষ অতিক্রম করে আজ ১৫৬তম জন্ম জয়ন্তী । উত্তর বঙ্গ শুধু নয় অবিভক্ত বঙ্গের রাজবংশী জনজাতির মনিষী, উত্তর বঙ্গের রাজবংশীদের “আম্বেদকর” রায় সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা। তিনি আজীবন রাজবংশীদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রীক উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট ছিলেন।
Dipu Ray, Author/Contributor
ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বাংলা ১২৭২ সনের ১লা ফাল্গুন , পূর্বতন কুচবেহার রাজ্যের (বর্তমান কোচবিহার জেলা) মাথাভাঙার খলিসামারি গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন খোসাল সরকার, মাতা ছিলেন চম্পলা দেবী।
খলিসামারিতে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি মাথাভাঙায় ইংলিশ মিডল স্কুলে ভর্তি হন। এরপর রাজশাহী বিভাগ (তখন বাংলা ভাগ হয়নি) থেকে প্রথম স্থান পেয়ে স্কলারশিপ পান। এরপর কোচবিহার রাজের প্রতিষ্ঠিত ভিক্টোরিয়া কলেজ ( বর্তমানে এ.বি.এন. শিল কলেজ) থেকে এফএ, বিএ এবং এমএ পাশ করেন। এরপর তিনি কোচবিহার রাজ্যে চাকরির জন্য আবেদন করেন কিন্তু তাঁকে তাঁর যোগ্যতা অনুসারে চাকরি না দিয়ে হস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট এর চাকরি দেওয়া হয়।
এখানে একটা দূর্ঘটনা ঘটে। হস্টেলে পাঠরত অরাজবংশী ছাত্ররা রাজবংশী ছাত্রদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। হস্টেলের হেঁসেল থেকে রাজবংশী ছাত্ররা ভাতের হাড়ি থেকে প্রথমে ভাত নেওয়ায় অরাজবংশী ছাত্ররা বচসা বাঁধায়। তারা ভাত ফেলে দেয়। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা অতিশয় বিস্মিত ও দুঃখিত হন। ছাত্রদের মনে জাত-পাতের মতন বিষ ছড়িয়ে পড়েছে দেখে তাঁর মনকে পীড়া দেয়। সর্বোপরি কোচ-রাজবংশের মানুষ স্বজাতি রাজবংশী ছাত্রদের ওপর এইরকম জাতি-বিদ্বেষি আচরণ দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। হস্টেল সুপারিন্টেন্ডেট এর কাজটি তাঁর মনঃপূত নাহওয়াতে তিনি এই কাজটি ছেড়ে দিয়ে কুচবিহার কলেজে আইন পড়া শুরু করেন। এরপর আইন পড়া শেষ হলে তিনি রংপুর গিয়ে ওকালতি আরম্ভ করেন। এখানেও তিনি নিজেই জাতি-বিদ্বেষের শিকার হন। তিনি ভুল করে উকিল মৈত্রের টোগা পরিধান করে কোর্টে শওয়াল করতে গিয়েছিলেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে টোগা ফেরত দিতে গেলে উকিল মৈত্র ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠেন- ” I hate to use the toga, used by a Rajbanshi” । তিনি অত্যন্ত অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন সমাজের তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত মানুষের এইরূপ আচরণে । তিনি এর একটা বিহিত করার জন্য লেগে পড়েন।
তিনি শুরু করেন “ক্ষত্রিয় আন্দোলন”। তিনি তাঁর সহযোগিদের সহায়তায় মিথিলা, কামাখ্যা, রংপুর, কোচবিহার থেকে ব্রাহ্মণ এনে করতোয়া নদীর তীরে মহাযজ্ঞ করান আর মস্তক মুণ্ডন করে উপবিত ধারণ করে ১৩১৯বঙ্গাব্দের ২৭শে মাঘ রাজবংশীদের পূন্ড্র ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করান। আজ ২৭শে মাঘ রাজবংশীদের কাছে “মহামিলন দিবস”। প্রতি বছর তা মহাসমারোহে পালিত হয়। শুধু তাই নয় বৃটিশ ভারতে জনগণনায় তিনি রাজবংশীদের ‘কোচ’ রাজবংশী লেখান। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে বৃটিশ সরকার সৈন্য সংগ্রহে তৎপর হয়। তিনি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। প্রথম শিফ্টে ৭০০ রাজবংশী যুবক যুদ্ধে যায়। এরপর আরো কয়েক হাজার রাজবংশী যুবক প্রস্তুত হয়। ঠাকুর পঞ্চাননের লক্ষ্য ছিল এই সুযোগে রাজবংশী যুবকদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি যোদ্ধাসত্ত্বার উন্মেষ ও বিকাশ সাধন। কিন্তু অতি দ্রুত তুরস্কের পতন হলে আরো সৈন্যিকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। বৃটিশ সরকার ঠাকুর পঞ্চাননকে প্রশংসা সূচক চিঠি পাঠান। এমনকি বৃটিশ সরকারকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য তাঁকে MBE পদক ( Member of British Empire) প্রদান করে। ঠিক একই কারনে মহাত্মা গান্ধীকে বৃটিশ সরকার কাইজার-ই-হিন্দ স্বর্ণ পদক প্রদান করেছিল। বিশেষ উল্লেখ্য কোচবিহার ছিল বৃটিশ মিত্র রাজ্য। বৃটিশ রাজপরিবারের সাথে কোচ রাজপরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। তাই কোচবিহার রাজ্যে বৃটিশ বিরোধি সংগ্রাম ততটা হয়নি। যদিও অন্যান্য অঞ্চলে সংগ্রাম হয়েছিল।
১৯২৯ খ্রীঃ মহাত্মা গান্ধীজি ও বাবা সাহেব আম্বেদকর এর মধ্যে “পুণা চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়, আর ১৯৩২খ্রীঃ লন্ডনে দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক আয়োজিত হলে আম্বেদকর তফশিলী জাতি ও উপজাতির প্রতিনিধত্ব করেন (**বিশেষ উল্লেখ্য- বাবা সাহেব আম্বেদকর শুধু তফশিলী সংরক্ষণ এর জনক নন, তিনি আধুনিক ভারতের রূপকার, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত অধ্যয়ণ জরুরি।) এবং ভারতে তাঁদের সংরক্ষনের ব্যবস্থা করেন। দূরদর্শী ঠাকুর পঞ্চানন রাজবংশীদেরকেও তফশিলী ভুক্ত করেন।
শুধু তাই নয়, তিনি চেয়েছিলেন গ্রামীন কৃষিভিত্তিক জীবিকা নির্ভর রাজবংশীদের সার্বিক উন্নতি সাধন। তিনি নিজ উদ্যোগে গ্রামীন সমবায় ব্যাঙ্ক গঠনে মনোনিবেশ করেন, যাতে সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে মন দেয় এবং আপদের সময় অসুবিধায় না পড়েন। তিনি রাজবংশী ছাত্র-যুবদের জন্য ক্ষত্রিয় হস্টেল নির্মান করেন। ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে সাহিত্য তাই তিনি পত্রপত্রিকা প্রকাশনায় মন দেন।
সর্বোপরি যা উল্লেখ্য না করলেই নয়, ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা নারীদের বিরুদ্ধে ঘটা নির্যাতন ও অপরাধ প্রতিরোধে উদ্যোগি হয়েছিলেন। আজকের ভারতে অহরহঃ ঘটে চলা নারী ধর্ষণ আর নির্যাতনের ঘটনা দেখলে, তাই ঠাকুর পঞ্চাননের প্রয়োজনিয়তা অনুভব হয়। তিনি নারী সুরক্ষা ও নারী আত্মরক্ষার জন্য গঠন করেছিলেন “ডাঙধরী মাও“(রাজবংশী-কামতাপুরি ভাষা) যার বাংলা অর্থ “দন্ডধারিনী মা”।
যিনি আজীবন জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন কিন্তু স্বজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের। তিনি ডাক দিয়েছিলেন-
” হিন্দু মুসলমান বিচার নাইরে,
মানুষজন তো নহায় ভিন।
উলসী ধায়া আর্তের উদ্ধার
এই ক্ষত্রিয়ের চিন।”
অর্থাৎ
” হিন্দু মুসলমান বৃথা বাছবিচার,
মানুষ মাত্রই, নয় কেউ ভিন্ন।
ছুটে গিয়ে আর্তের উদ্ধার
এই তো ক্ষত্রিয়ের চিহ্ন।”
তিনি স্বজাতিকে আত্মবলিয়ান হবার দীক্ষা দিয়েছেন –
” তোর আশা সগায় কোরুক, তুই কাঁহোরো আশা করিস না।”
অর্থাৎ- “অন্যের কাছে আশা না করে তুমি নিজেই অন্যের আশা পূরণের যোগ্য হও তোমার আশা অন্যরা করুক।”
এই মহামানবের জীবনাবসান হয় বঙ্গাব্দ ১৩৪২ এর ২৩শে ভাদ্র ( ইংরেজি ১৯৩৬)।
তাঁকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি। পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকার তাঁর আবির্ভাব ও প্রয়াণ দিবসে সরকারিভাবে উদযাপন করার নির্দেশিকা জারি করেছে।
তথ্যসূত্র:-
১] মহামানবের কাথা (গ্রন্থ)- বর্মন, হরিমোহন
২] রায় সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার জীবনি (গ্রন্থ)- বর্মা, ক্ষিতেন্দ্র নাথ
৩] ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার জীবন ও দর্শন (প্রবন্ধ)- কুমার মৃদুল নারায়ণ, কোচবিহার রাজ পরিবারের সদস্য।