Dooars Gandhi, Vidyasagar of Dooars, Freedom Fighter Jajneswar Ray.
ভূমিকা
আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঐতিহাসিকদের মত অনুসারে নরমপন্থী আর চরমপন্থী দটিু ধারার ছিল। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম মূলত তিনটি ধারায় ধাবিত হয়েছে। একটি ধারা অস্ত্র হাতে সংগ্রাম করে , যার প্রধান মুখ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, ভগৎ সিং, মাস্টারদা সূর্য সেন, রামপ্রসাদ বিসমিল, চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয় প্রমুখ। দ্বিতীয় ধারাটিসত্য-নিষ্ঠাকে আদর্শ করে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে। যার প্রধান মুখ মহাত্মা গান্ধী তথা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আর তৃতীয় ধারাটি হল মানুষের মধ্যে দেশাত্মবোধ-জাতীয়তাবোধ-স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলার জন্য আধ্যাত্মিক এবং সাহিত্যের মাধ্যমে। যার প্রধান মুখ স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম প্রমুখ।
Writen by Dipu Ray
তবে আমি আলোচনা করতে চলেছি গান্ধীবাদি ভাবাধারায় দিক্ষিত ডুয়ার্সের রত্ন সম্পর্কে। আমরা সবাই ইতিহাস পড়েছি , ইতিহাস আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ভারতের জাতির জনক সত্য-নিষ্ঠা-ন্যায়কে আদর্শ করে ‘সত্যাগ্রহ’মন্ত্রে দেশকে দীক্ষা দাতা মহাত্মা গান্ধী তথা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীজির সঙ্গে। গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত ‘সীমান্তগান্ধি ‘(Frontier Gandhi) নামে পরিচিত খান আব্দুল গফ্ফর খান এর সঙ্গে । কিন্তু কী নিষ্ঠুর পরিহাস গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত স্বাধীনতা সংগ্রামী, কর্মবীর, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষার প্রসারক, বিদ্যোৎসাহী ‘ডুয়ার্স গান্ধী’ যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয় আজ ভারতের ইতিহাসে সম্পূর্ণ অপরিচিত ,অবহেলিত। চলুন না আজ তাঁর কথা জেনে নিই, তাঁকে চিনে নিই।
স্বাধীনতা সংগ্রামী যজ্ঞেশ্বর রায়
স্বাধীনতার পূর্বে বিস্তীর্ন ডুয়ার্সের মাটিতে যিনি ইংরেজ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এবং ৩ দিন পর্যন্ত কুমারগ্রাম থানা নিজের দখলে রেখে ছিলেন তিনি আর কেউ নন, একজন জাগ্রত দেশপ্রেমিক, সমাজসেবি , শিক্ষার প্রশারক, স্বাধীনতাসংগ্রামী ডুয়ার্স গান্ধী স্বর্গীয় যজ্ঞেশ্বর রায়।
জন্ম ও পরিচয়
যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয় জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ৭ই জৈষ্ঠ ১৩০৭সন, অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার দোমোহনির মরিচবাড়ি গ্রামে (Marichabari, Domohani, Jalpaiguri) । তাঁর পিতার নাম ছিল শ্রী মোহন সিং রায় (Shri Mohan Singh Ray) আর মাতার নাম ছিল পানশ্বরি রায় (Smt. Panswari Ray)। সেই সময় ডুয়ার্সের এই অঞ্চলটাছিল ভুটান রাজের অধিনে আর যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয়ের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মরিচবাড়ির দেওয়ান (মন্ত্রী স্বরূপ) আর দেওয়ানের উপাধি ছিল ‘প্রধান’। তাই তার পূর্ব পুরুষরা উপাধি হিসাবে রায় প্রধান লিখতেন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ডুয়ার্স গান্ধী যজ্ঞেশ্বর রায়ের অবদান
যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আলিপুরদুয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ে (Alipurduar High School) ভর্তি হন। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষাদেবার আগেই তিনি ডুয়ার্সের স্বাধীনতা সংগ্রামী নলিনী পাকরাশির (Nalini Pakrashi) সংস্পর্শে এসে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। যদিও তাঁর এই কর্মকান্ডে রায় বাড়িতে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি করে, কিন্তু তিনি তাঁর কাকা শ্রী দ্বারিকা নাথ রায় মহাশয়ের সহযোগিতা ও উৎসাহে সর্বাত্মক ভাবে জাতীয় আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন।
১] অসহযোগ আন্দোলন : মহাত্মা গান্ধীজির ডাকে সারাদেশ ঝাপিয়ে পড়েছিল ১৯১৯-২০ এর অসহযোগ আন্দোলনে। ডুয়ার্সে যার নেতৃত্ব দেন যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয়।
২] আইন অমান্য আন্দোলন, স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন : অসহযোগ আন্দোলনের পর আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০)এবং স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে ও ডুয়ার্সের বুকে নেতৃত্ব দেন তিনি। এই ‘স্বদেশি ‘ অর্থাৎ দেশিয় পণ্যের প্রচলন বৃদ্ধি। সেই সময় রজনীকান্ত সেন এর গান “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই..”, আর ‘বয়কট’ অর্থাৎ বিলেতিপণ্যের বর্জন, সেই বিষয়ে ও একটা গান আছে – ” ফেলে দে রেশমী চুরি , বঙ্গ নারী আর কভু হাতে পড়ো না..”।
৩] খাজনা বন্ধের আন্দোলনে যজ্ঞেশ্বর রায় : আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালিন ডুয়ার্সে যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয় খাজনা বন্ধের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা গ্রামীন হাটগুলি কে প্রচারে র মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, যাতে বেশি সংখ্যক মানষেুষের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সে সময় তিনি আন্দোলনকে জোড়ালো করতে একটি ধ্বনি দিয়ে ছিলেন, সেটি হল -“জান দিম্, প্রাণ দিম্, খাজনা দিম্ না।” যেটি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক উৎকৃষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল।
৪] পঞ্চাশের মন্বন্তর মোকাবিলা : ১৯৪৩ সাল তথা ১৩৫০ বঙ্গাব্দ, বৃটিশ অপশাসন আর দেশিয় অসাধু আঁড়তদার মজুতদারদের যৌথ আক্রমণে সেই ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যার করুন চিত্র কিশোর কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফ্যান’ কবিতায় ফুটে উঠেছে – ” নগরের পথে পথে দেখি এক অদ্ভূত জীব/…বসে বসে ধোঁকে আর ফ্যান চায়..।” ডুয়ার্সের বুকে মন্বত্বর মোকাবিলায় অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী যজ্ঞেশ্বর রায়।
৫] ভারত ছাড়ো আন্দোলন : ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, মহাত্মা গান্ধীজি ডাক দিয়েছিলেন “ইংরেজ ভারতছাড়ো”, দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে “। ডুয়ার্সে ও যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয় ও তাঁর সহযোদ্ধারা ব্যাপক সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁরা কুমারগ্রাম থানা আক্রমণ করে আর তিন দিন ধরে বৃটিশ সিংহের দম্ভকে পদানত করে রাখে ।পরে বৃটিশ সরকার সেনাবাহিনী তলব করলে তাঁরা বাধ্য হয়ে পিছু হটেন।
ডুয়ার্সের বিদ্যাসাগর যজ্ঞেশ্বর রায়
যজ্ঞেশ্বর রায় মহাশয়কে শুধু ‘ডুয়ার্স গান্ধী’ নয় ‘ডুয়ার্সের বিদ্যাসাগর’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে বিস্তীর্ন ডুয়ার্স অঞ্চল জুড়ে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন তিনি। মাদারি হাট বীরপাড়া ব্লকের অন্তর্গত রাঙ্গালি বাজনার (Rangali Bajna) মতো জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে সম্পূর্ণ নিজের খরচে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার আলো জ্বালানোর জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। শুধু তাই নয় বিদ্যালয়ের উন্নতি কল্পে নিজের ১৪০বিঘা জমিদান করেন। শুধু রাঙ্গালী বাজনাতেই নয় তিনি ডুয়ার্সে একাধিক স্থানে প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যথা –
১] ফালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়
২] জল্পেশ উচ্চ বিদ্যালয়
৩] কুমার গ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়
৪] জটেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়
৫] রাঙ্গালি বাজনা নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়
৬] ডাউকি মারি উচ্চ বিদ্যালয়
৭] আমগুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়
৮] হেলা পাকড়ি উচ্চ বিদ্যালয়
এছাড়াও অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁকে ডুয়ার্স গান্ধী বলার পাশাপাশি ডুয়ার্সের বিদ্যাসাগর বললেও অত্যুক্তি হবে না।এমনকি সে সময় তিনি একটি প্রিন্টিং প্রেস ও নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া আরো অনেক সমাজ কল্যাণ কারি কাজের কথাও শুনতে পাওয়া যায় লোকমুখে। আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে সমাজে ভালো ব্যক্তি রা বেশী দিন থাকে না, ওনার এই সব কাজ কিছু সমাজ বিরোধী মানুষের সহ্য হচ্ছিল না। কিছু দুষ্কৃতীর হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হল ওনাকে । গান্ধীজির ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ডুয়ার্স গান্ধী যজ্ঞেশ্বর রায়ও গান্ধীজি র মত করেই দুষ্কৃতীর হাতে খুন হলেন ১৯৭১সালে। এভাবে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজ সেবি, শিক্ষার প্রসারক, দেশ মাতৃকার মহৎ সন্তানের জীবনাবসান ঘটল। কিন্তু তাঁর কীর্তি, তাঁরসমাজ কল্যানের জন্য তিনি আজও ডুয়ার্স বাসীর অন্তরে অমর হয়ে বেঁচে আছেন, সরকার তাঁর অবদানের স্বীকৃতি না দিলেও ডুয়ার্সবাসীই তাঁকে সম্মান জানিয়ে ‘ডুয়ার্স গান্ধী’ অভিধা দিয়েছে।
তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১] মহামানবের কাথা- বর্মন , হরিমোহন, প্রাচীন নথি পত্রের সংগ্রাহক, গবেষক, লেখক, রাঙ্গালীবাজনা মোহন সিং উচ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক।
২] হীরক জয়ন্তী স্মারক পত্রিকা- রাঙ্গালি বাজনা মোহন সিং উচ্চ বিদ্যালয়।
৩] Dooars Gandhi Jajneswar Ray: His work and Contribution – Ray, Dr. Dinesh Chandra