কুচবিহার বা কোচবিহার রাজবংশ এর পরিচিতি / Koch Dynasty or Royal Family of Coochbehar
খেন রাজবংশের পর বিভিন্ন গ্রামে ভূঁইয়া গণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অঞ্চলে প্রভুত্ব করতেন। এই সময়ে মেচ দলপতি হরিদাস মণ্ডল বা হারিয়া মন্ডল নামে এক মেচ সর্দার অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। কোচ নায়ক হাজোর হীরা ও জিরা নামক দুই কন্যার বিয়ে হয় মেচ যুব হাড়িয়া মন্ডল এর সঙ্গে। হরিদাস মন্ডল গোয়ালপাড়া জেলার চিকনা পর্বত বাসী ছিলেন। জ্যেষ্টা পত্নী জিরার গর্ভে চন্দন ও মদন নামে দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করে। কনিষ্ঠা পত্নী হীরার গর্ভে শিবের আশীর্বাদে দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। শিশু (শিষ্যসিংহ) ও বিশু (বিশ্বসিংহ)। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ চন্দন প্রথম কোচ রাজবংশ এর (Koch Dynasty) রাজা হন। তিনি পাঁচ বছর রাজত্ব করেন। কোচবিহার রাজবংশ এর (Royal Family of Coochbehar) শেষ রাজা ছিলেন মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণ।
মহারাজা বিশ্বসিংহ / Maharaja Biswa Singha (১৫১৫-১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দ)
চন্দন এর মৃত্যুর পর বিশ্বসিংহ ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আসীন হন, মতান্তরে তিনিই প্রথম রাজা। কোচ রাজাদের মধ্যে বিশ্ব সিংহ প্রথম কান্তেশ্বর উপাধি ধারণ করে কামতা রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি রাজধানী হিঙ্গুলাবাসে স্থানান্তরিত করেন। তিনি সৌমার দেশ বিজনি, বিজয়পুর, জয় করেন। ভুটানের রাজা তাকে কর ও উপঢৌকন দিতে স্বীকৃত হন। গৌড়ের কিছু অংশ তিনি দখল করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্ব সিংয়ের রাজ্যভিষেককালীন তার ভাই শীর্ষ সিংহ মাথায় ছত্র ধারণ করলে তিনি রায়কত বা দূর্গাধিপতি (Cheif of Fort) উপাধি প্রাপ্ত হন। এই শিষ্যসিংহ বর্তমান জলপাইগুড়ি শহরের বক্ষে বৈকন্ঠপুর এর রায়কত বংশের সূচনা করেন। বিশ্ব সিংহ তার পুত্র নরনারায়ণ ও শুক্লধজকে শিক্ষার জন্য বারানসী পাঠিয়েছিলেন। তারা সংস্কৃত, ব্যাকরণ, সাহিত্য, জ্যোতিষ ,স্মৃতি,ও পুরাণে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। বিশ্ব সিংহ ছিলেন শিবদুর্গার একান্ত উপাসক।
Koch Rajbansha
মহারাজা নর নারায়ণ / Maharaja Nara Narayan (১৫৩৩-৩৪-১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দ)
বিশ্বসিংহ এর মৃত্যু হলে নরসিংহ তার জ্যেষ্ঠপুত্র হলেও দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়ণ কোচবিহারের রাজ সিংহাসনে বসেন। তিনি নারায়নী মুদ্রার প্রচলন করেন। অসমের ধর্মগুরু শংকরদেবের আশ্রয়গ্রহণ ও তার ধর্মপ্রচার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৈষ্ণবভক্তদের ইতিহাস বিস্তার লাভ করে । শংকরদেবের আশ্রম এ স্থান মধুপুর। এখনো কুচবিহারের মধুপুর গ্রামে আসামের অগণিত মানুষ প্রতিবছর পুণ্যের জন্য আসেন। নরনারায়ণ ও তার ভাই চিলারায় উভয়ে ধার্মিক ছিলেন। তিনি তার ভাইয়ের সাহায্যে রাজ্যকে সাম্রাজ্যের রূপ দেন।তিনি অহম, কাছার, মনিপুর, জয়ন্তিয়া, শ্রী হট্ট, ত্রিপুরা, খাইরুম, ডিমরুয়া প্রভৃতি রাজ্য জয় করেন। তবে গৌড় আক্রমণ করে সফল হননি।
তার ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে অহম রাজ কে লেখা চিঠি প্রথম বাংলা গদ্যের নিদর্শন বলে স্বীকৃত হয়। চিঠিটি ছিল এই রূপ “তোমার আমার সন্তোশ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকুল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার কর্তব্যে সে বর্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক “। সংকোশ নদী কে সীমান্ত করে পূর্বদিকে নিজ অধিকার রাখেন এবং পশ্চিম দিক ভাই শুক্লধজকে দেন। তিনি বড় দেবীর পূজা প্রচলন করেন এবং কামাখ্যা মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন। তিনি শিক্ষা এবং সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
See more images on Koch Rajbansha
মহারাজা লক্ষীনারায়ণ / Maharaja Lakshmi Narayan (১৫৮৭-১৬২৭ খ্রীষ্টাব্দ)
মহারাজা নরনারায়ণের মৃত্যু ঘটলে পুত্র লক্ষীনারায়ণ সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনিও স্বনামে মুদ্রার প্রচলন করেন। তিনিও অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন। মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে তার বিরোধ ও রাজ্যের অনেকাংশ মোঘলরা দখল করেন। মোঘল সেনাপতি মানসিংহ সাথে সন্ধি 1596 খ্রিস্টাব্দে ও তার সাথে বোন প্রভাবতীর বিয়ে দেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক গ্রন্থ রচিত হয়।
মহারাজা বীর নারায়ণ / Maharaja Bir Narayan (১৬২৭-১৬৩২ খ্রীষ্টাব্দ)
বীর নারায়ণের সময় রায়কতরা মহারাজের মাথায় ছাত্র ধারণ করেনি। নাজির মহিনারায়ণ ছত্রধারণ করেন এবং ছত্র নাজির উপাধি পান। তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন, টোল,পাঠশালা স্থাপন করেন। ভেলাডাঙ্গায় চতুর্ভুজ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।
মহারাজা প্রাণ নারায়ণ / Maharaja Pran Narayan (১৬৩২-১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দ)
তিনি ছিলেন সুশিক্ষিত, শাস্ত্রজ্ঞ ও ধার্মিক রাজা। সংগীতের গ্রন্থ রচনা করেন। গোসানিমারি, বানেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি জল্পেশ মন্দিরের নির্মাণ শুরু করেন। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে মীরজুমলা কুচবিহার আক্রমণ করেন ও দখল করেন। পরবর্তীতে তিনি মোগলদের তাড়িয়ে নিজের রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। তিনি পঞ্চরত্ন সভা গঠন করেন। বিষ্ণু নারায়ণ, মোদ নারায়ণ ও বসুদেব নারায়ণ এই তিনজন তার পুত্র ছিলেন।
মহারাজা মোদ নারায়ণ / Maharaja Mod Narayan (১৬৬৫-১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দ)
প্রাণ নারায়ণের মৃত্যু ঘটলে দ্বিতীয় পুত্র মোদ নারায়ণ সিংহাসন আরোহন করেন। তার সময়ে সিংহাসন নিয়ে নাজির দেও মহি নারায়ণ ও তার পুত্রদের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। অবশ্য তিনি তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। শিখ ধর্ম গুরু তেগ বাহাদুর তার সময়ে কোচবিহারে আসেন। তিনি জল্পেশ মন্দির নির্মাণ করেন। রাজ কার্যদক্ষতা দৃষ্টে নবাগত ব্রাহ্মণ রূপচাঁদ মজুমদারকে রাজস্ব বিভাগে নিযুক্ত করেন এবং তাকে মুস্তাফী পদবী প্রদান করেন। এই রূপ চাঁদের মোস্তাফি উপাধিধারী গন কোচবিহারের দক্ষিণের গোবরছাড়া গ্রামে তার বংশধরগণ এখনো বসবাস করেন। তার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর কনীয়ান ভাই বসুদেব নারায়ণকে সিংহাসন প্রদান করেন।
মহারাজা বসুদেব নারায়ণ / Maharaja Basudeb Narayan(১৬৮০-১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দ)
এইসময় মহি নারায়ণের পুত্ররা ভুটিয়াদের সাহায্যে রাজ্য দখলের চেষ্টা করে। রায়কত জগ্যদেব ও ভুজ দেব তাদের পরাজিত করেন। মহি নারয়ণের পুত্ররা আবার আক্রমণ করলে মহারাজা ধৃত এবং নিহত হন। জগ্যনারায়ণ রাজা হতে চেষ্টা করে অনেককে হত্যা করেন। কিন্তু জগ্যদেব ও ভুজদেব তাদের যুদ্ধে পরাজিত করেন।
মহারাজা মহিন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Mahindra Narayan (১৬৮২-১৬৯৩ খ্রীষ্টাব্দ)
রায়কতদয় প্রাণ নারায়ণ এর প্রপৌত্র পাঁচ বছরের মহিন্দ্র নারায়ণ কে সিংহাসনে বসান। কিন্তু রায়কতরা ফিরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভিভাবকহীন মহিন্দ্র নারায়ণ তাই রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টিকারী জগ্য নারায়ণকে নাজির পদে বসান। এই সময় মোঘলরা বোদা,পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ দখল করে নেয়। অনেক রাজকর্মচারীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বৈকন্ঠপুর এর রায়্কতরা, পাঙ্গার রাজকুমার ও ভুটান রাজ কর ও উপঢৌকন দেওয়া বন্ধ করে।
মহারাজা রূপনারায়ণ / Maharaja Rup Narayan(১৬৯৩-১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দ)
মহিন্দ্র নারায়ণের যৌবনে মৃত্যু হলে মহিনারায়ণের এর পৌত্র রূপনারায়ণ কে রাজ সিংহাসনে বসান নাজির শান্ত নারায়ণ। রূপনারায়ণ রাজধানী ১৮ কোটা হতে গুরিয়াহাটিতে স্থানান্তরিত করেন এবং রাজধানীতে মদনমোহন বিগ্রহ স্থাপন করে নিয়মিত পূজার ব্যবস্থা করেন। তিনি জ্ঞানী, ধার্মিক, বলবান ,সাহসী ও দয়ালু ছিলেন। রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি মুঘল ফৌজদারের সাথে যুদ্ধ করেন কিন্তু বিশাল মোঙ্গলবাহিনীর সাথে জেতা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাদের সাথে সন্ধির ফলে বোদা, পাটগ্রাম ,পূর্বভাগ চাকলা মুঘলদের অধীনে যায়। গুরু মহারাজা রুপনারায়ণ মদনমোহনের অষ্টধাতুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।
মহারাজা উপেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Upendra Narayan (১৭১৪-১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দ)
উপেন্দ্র নারায়ণের সময়ে ভুটিয়ারা সীমানা অতিক্রম করে নিম্নভূমির দিকে অগ্রসর হয়ে লুটতরাজ শুরু করেন। মহারাজা তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেননি। তারা অনেক স্থান অধিকার করে নেয়। দেওয়ান দেও এর মদতে মোগলরা পশ্চিমাংশ আক্রমণ করেন। এই সময়ে প্রবল ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তিনি ছোটরাণীকে নিয়ে ধলুয়াবাড়ি রাজ বাড়িতে থাকতেন এবং বড় রানী কোচবিহারে থাকতেন।
মহারাজা দেবেন্দ্রনারায়ণ / Maharaja Debendra Narayan (১৭৬৩-১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দ)
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ধলুয়াবাড়ির অস্থায়ী প্রাসাদে মহারাজা উপেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু হলে শিশুপুত্র কুমার দেবেন্দ্রকে আইদেবী রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন। মহারাজার অভিষেক কালে তার মাত্র চার (৪) বছর বয়স ছিল। এই সময় ভুটান রাজের একজন প্রতিনিধি সৈন্যসহ এখানে বাস করতেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। সুযোগ বুঝে রাজ্যের শাসন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আরম্ভ করেন। দেবেন্দ্র নারায়ণ শিশু বন্ধুদের সঙ্গে খেলা স্থলেই এক অন্তর্ঘাতের শিকার হন। রাজগুরু রামানন্দ গোস্বামী চক্রান্তে রতি শর্মা নামক একজন ব্রাহ্মণ অস্ত্রাঘাতে রাজার মাথা কেটে ফেলেন মাত্র ছয় বছর বয়সে। শেষ পর্যন্ত ঘাতক রতি শর্মার ও একই পরিণতি ঘটে উপস্থিত দর্শকদের হাতে এবং পরবর্তীকালে ভুটানরাজ রামানন্দ গোস্বামী কে চক্রান্তকারী হিসেবে প্রাণদণ্ড দেন।
মহারাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ / Maharaja Dhairjendra Narayan (প্রথমবার) ১৭৬৫-১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দ
মহারাজ দেবেন্দ্র নারায়ণের উত্তরাধিকারী কেউ না থাকায় দেওয়ান দেও রাম নারায়ণের তৃতীয় ভাই ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণকে রাজা করেন। সিংহাসনে বসেই মহারাজ বড় ভাইকে হত্যা করে ছোট ভাই সুরেন্দ্র নারায়ণকে দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন। ভুটানের দেবরাজ এই সংবাদ প্রাপ্ত হলে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং চেকাখাতায় বার্ষিক ভোজসভা আয়োজনের ভান করে মহারাজ ও দেওয়ান দেওকে বন্দি করে ভুটানে নিয়ে যান। বন্দীদের ভুটানের তৎকালীন রাজধানী পুনাখায় নিয়ে রাখা হয়।
মহারাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ / Maharaja Rajendra Narayan (১৭৭০-১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দ)
মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণকে বন্দি করে ভুটিয়ারা তার ভাই রাজেন্দ্রনারায়ণ কে কৌশলে রাজসিংহাসনে বসান। তবে এই রাজা নির্বাচন কুলপ্রথা অনুসারে হয়নি। রাজ্যে ভুটিয়া শাসন প্রবর্তিত হল এবং পেনশু তোমা-ই রাজ্যের সর্বসেবা হয়ে ওঠেন এবং রাজ কর্মচারীগণ সকলেই তাঁর আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েন। রাজা এবং নাজির দেও তার হাতের পুতুলের মত ছিলেন। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে চৈত্র মাসে রাজা বিয়ে করেন এবং বিয়ের সাতদিনের মধ্যে রাজার মৃত্যু হয়। এই কারণে লোকমুখে তিনি “লখাই রাজা” নামে পরিচিত। এই অধ্যায়ের পরেই কোচবিহারে স্বাধীন রাজাদের রাজত্ব শেষ হয় এবং ইংরেজদের সহায়তায় ভুটান রাজশক্তির উচ্ছেদ করে নতুন যুগের সূচনা হয়।
মহারাজা ধরেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Dharendra Narayan (১৭৭২-১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দ)
রাজেন্দ্র নারায়ণের পর সিংহাসন নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে ভুটান প্রতিনিধির আদেশ অগ্রাহ্য করে নাজির দেও ও অন্যান্য পরিবারবর্গ বন্দি মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণের পুত্র ধরেন্দ্র নারায়ণ কে সিংহাসনে বসান। ভুটানরাজ বন্দী রাজার পুত্র কে রাজা করায় ক্ষুব্ধ হন এবং পুনরায় ভাগিনেও জিম্পেকে কোচবিহার অধিকার করতে পাঠিয়ে দেন। তিনি কোচবিহাররাজের সৈন্যদের হারিয়ে দিয়ে রাজ্য দখল করেন। বালক মহারাজ ও রাজমাতা রংপুরে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন এবং নাজির দেও পরিবার আসামের রাঙামাটিতে চলে যান। এই মহাবিপদের হাত থেকে মুক্তি পেতে নাজিরদেও এবং রাজ কর্মচারীগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল তারিখে ফোর্ট উইলিয়ামে নাবালক মহারাজের পক্ষে নাজিরদেও এবং ইংরেজ গভর্মেন্টের সন্ধিপত্র লিখিত হয়। এই সন্ধিপত্রে নয়টি শর্ত ছিল। সন্ধি অনুসারে ইংরেজ সেনাপতি জোনস্ এর নেতৃত্বে যুদ্ধে ভুটিয়াদের পরাজিত করে হঠিয়ে দেন। ভুটান রাজ ভীত হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন এবং সন্ধির শর্তানুসারে ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ বন্দিদশা হতে মুক্তি পান। কারামুক্তির পর রাজা যে স্থানে এসে প্রথম ভাত খান সেই জায়গার নাম রাজাভাতখাওয়া (Rajabhatkhawa)। বর্তমানে “রাজাভাতখাওয়া “আলিপুরদুয়ার জেলা শহরের নিকটে একটি প্রসিদ্ধ দর্শনীয় জায়গা।
এই সময় থেকেই কোচবিহার রাজ্য ইংরেজদের করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হয়
মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Dhairjendra Narayan (দ্বিতীয়বার ) (১৭৭৫-১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দ)
পুত্র ধরেন্দ্র নারায়ণ এর মৃত্যু ঘটলে ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ দ্বিতীয়বার রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। পুত্রের অকাল মৃত্যুতে অনিচ্ছাকৃতভাবে দ্বিতীয়বার সিংহাসনে বসলেও রাজকার্যে মনোনিবেশ করতে পারেননি। মহারানী এবং রাজগুরু সর্বানন্দ রাজকার্য চালাতেন। রাজগুরু হরেন্দ্র নারায়ণের আমলেও পরামর্শদাতা ছিলেন। এই সময় রংপুরে প্রজা বিদ্রোহ দেখা দেয়। ছত্রনাজির খগেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গেও রাজ্য শাসন বিষয়ে তার বিরোধ দেখা দেয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রক্ত আমাশয় ধৈর্যেন্দ্র্ নারায়ণ এর মৃত্যু হয়।
মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণ /Maharaja Harendra Narayan (১৭৮৩-১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দ)
মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালকে বলা যেতে পারে পুরনো শাসনব্যবস্থা থেকে নতুন শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণের যুগ। মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণের বিচক্ষণতায় রাজ্যের রাজকার্যের চেহারা বদলে যায়। তিনি ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে “সাগরদিঘী” পুকুরটি খনন করেন এবং তার পশ্চিমপাশে হিরণ্যগর্ভ শিব মন্দির স্থাপন করেন। তার আমলে ভেটাগুড়িতে প্রথম রাসমেলার সূচনা হয়। তিনি ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ভেটাগুড়িতে এবং ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ধলুয়াবাড়িতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। কোচবিহার শহরের “আনন্দময়ী কালী” তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একাধিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। নিজে ভালো গান লিখতে এবং গাইতে পারতেন। তাকে “কবিরাজা” বলা হয়। এই সময়ে রাজ্যে একাধিক সংস্কারমূলক কাজ হয়েছে। মহারাজের চেহারা খুব সুন্দর, হাসি মাখা মুখ মণ্ডল ও বাক্য বড় সুমধুর ছিল। তার সময়ে একাধিক বিষয়ে সাহিত্য চর্চা হয়। এই সময়কে কোচবিহারের সাহিত্যচর্চার গৌরবময় যুগ বলতে পারি। কোচ রাজবংশের ইতিহাসে বংশের এই মহারাজার রাজত্বের সময়সীমা সর্বাধিক। তিনি প্রজানুরাগী ছিলেন।
মহারাজা শিবেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Shibendra Narayan (১৮৩৯-১৮৪৭ খ্রীষ্টাব্দ)
রাজপরিবারে ভাইদের ভিতরে অন্তর্কলহ থাকলেও মহারাজা শিবেন্দ্র নারায়ণ শিক্ষা, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার নৈপুণ্যে ৪৩ বছর বয়সে রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। রাজ্কার্য পরিচালনার জন্য পণ্ডিতদের পরামর্শে “ধর্মসভা” নামে একটি সভা গঠন করেন। দেওয়ানী, ফৌজদারি ও রাজস্ব বিভাগের মোকদ্দমা পরিচালনার জন্য আদালত গঠন করেন। মহারাজা রাজকার্যে, বিচারকালে উপস্থিত থাকতেন। তিনি কাশীতে “করুণাময়ী” মন্দির নির্মাণ করেন। তার দুই মহিষীর নাম ছিল “কামেশ্বরী” (ডাঙ্গর আই) ও বৃন্দেশ্বরী (বড় আই)। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ শিবেন্দ্র নারায়ণ বারাণসীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Narendra Narayan (১৮৪৭-১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দ)
মহারাজ দেবেন্দ্র নারায়ণের কোন সন্তানাদি ছিল না। তার অনুজ ভ্রাতা ব্রজেন্দ্র নারায়ণের পুত্র নরেন্দ্র নারায়ণ মাত্র ছয় বছর বয়সে রাজা হন। রাজবংশে তিনি প্রথম ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হন। রাজার নাবালক অবস্থায় পিতা ব্রজেন্দ্র নারায়ণ ও তার মৃত্যুর পর রাজমাতাদয় রাজকার্য পরিচালনা করতেন। আসাম বিভাগীয় কমিশনার জেনকিনস সাহেব মহারাজের খুব বন্ধু ছিলেন এবং তাদের বন্ধুত্বের স্বীকৃতির জন্য জেনকিনস স্কুল স্থাপিত হয়। তার রাজ্যশাসনকালীন উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে সতীদাহ প্রথা নিবারণ, স্টাম্প আইন ও নিজের নামের স্ট্যাম্প কাগজ এর প্রচলন। রাজ্য উন্নয়নের একটা সার্বিক রুপ দিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর।
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Nripendra Narayan (১৮৬৩-১৯১১ খ্রীষ্টাব্দ)
প্রায় পাঁচশত বছরের কোচ রাজত্বের ইতিহাসে এক এক রাজা তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন মহতী কাজে দৃষ্টান্তে। মাত্র দশ মাসের শিশু মহারাজকুমার নৃপেন্দ্র নারায়ণ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহন করেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রাজা মারা গেলে উত্তরাধিকারীকে সিংহাসনে না বসানো পর্যন্ত মৃতদেহের সৎকারদি হতে পারত না। সকল কাজেই রাজার আদেশ মেনে চলতে হবে এ কারণেই এই প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। রাজা যখন নাবালক ছিলেন রাজ্যের শাসনভার প্রথমে মহারানীদের উপর এবং পরে ইংরেজ গভমেন্ট নিযুক্ত কমিশনারের উপর বর্তায় ছিল। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তাকে ইংরেজ গৃহ শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এবং বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে তাকে সুশিক্ষিত করা হয়।
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৬মার্চ নববিধান ব্রাহ্মসমাজ এর প্রবর্তক কেশবচন্দ্র সেনের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিয়ে হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর সাবালক হয়ে নৃপেন্দ্র নারায়ণ নিজের হাতে রাজ্যভার গ্রহণ করেন। তার শাসনকালে কোচবিহার আধুনিক কোচবিহারের রূপ নেয়। তাকে কুচবিহারের রূপকার বলা হয়। পরিকল্পিত ছবির মত শহর গড়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থান থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের এনে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেন। তার আমলে বহিরাগত দক্ষ কারিগর দ্বারা ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করা হয় ১৮৮৭ সালে। তিনি ইংরেজদের অনুকরণে প্রজা মঙ্গলের উদ্দেশ্যে একাধিক আইন প্রণয়ন করেন। কাজের সুবিধার জন্য এই সময়ে মাথাভাঙ্গা, দিনহাটা লালবাজার, মেখলিগঞ্জ ও তুফানগঞ্জে মহকুমা স্থাপিত হয়। এসময় বিদ্যা শিক্ষার চরম উন্নতি হয়েছিল। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টোরিয়া কলেজ স্থাপিত হয় এবং ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা,ও মেখলিগঞ্জে একটি করে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা নিজ ব্যয়ে মোগলহাট হতে কোচবিহার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করেন, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই রেলপথ খোলটা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। রাজ্যের শাসন প্রণালী, রাজস্ব ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে একাধিক জনমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একাধিকবার বিদেশে গিয়েছেন। কয়েকবার মহারানী, পরবর্তীকালে পুত্র-কন্যাদের নিয়ে বিদেশে ভ্রমণ করেছেন। এই সময় থেকেই রাজপরিবারের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। ইংল্যান্ডেশরী মহারানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে তার আত্মীয়তা তৈরি হয়। সুনীতি দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক ছিল। কৃষি উন্নয়নে, কারিগরি শিক্ষায়,পশুপালন প্রভৃতি বিষয়গুলোতে তার মনোযোগ ছিল অপরিসীম। তামাক চাষের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি একজন প্রতিনিধিকে বিদেশে প্রেরণ করেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে নারী শিক্ষার প্রসারে তিনি সুনীতি একাডেমী নির্মাণ করেন। ব্রিটিশ সরকার মহারাজা এবং মহারাণীকে একাধিক সম্মানে ভূষিত করেন।মহারানী ভিক্টোরিয়া মহারাজের তৃতীয় পুত্রের ধর্মমাতা হওয়ায় তার নাম হয় ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণ।
সর্ববৃহৎ ঠাকুরবাড়ি, নরেন্দ্র নারায়ণ পার্ক, সরকারি পাকা বাড়ি গুলির নির্মাণকার্য এই সময়ে সম্পন্ন হয়।
পূর্বে মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি রাজবাড়ী সংলগ্ন ছিল, পরে নৃপেন্দ্র নারায়ণ এই ঠাকুরবাড়ি নতুন স্থানে বৃহৎ বাড়ি নির্মাণ করে স্থানান্তরিত করেন ১৮৯০ সালে।
মহারাজার চার পুত্র ও তিন কন্যা। বিবরণ –
১) রাজ রাজেন্দ্রনারায়ণ, জন্ম ১৮৮২, ১১ এপ্রিল
২) জিতেন্দ্র নারায়ণ, জন্ম ১৮৮৬, ২০ ডিসেম্বর
৩) ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণ, জন্ম ১৮৮৮, ২১ মে
৪) হিতেন্দ্র নারায়ণ, জন্ম ১৮৯০, ১ জুলাই
১) সুকৃতি দেবী, জন্ম ১৮৮৪, ১৫ জানুয়ারি
২) প্রতিভা দেবী, জন্ম ১৮৯১, ২২ নভেম্বর
৩) সুধীরা দেবী, জন্ম ১৮৯৪, ৭মার্চ
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ কে যুবরাজের পদে বসানো হয়। মহারাজা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডে পরলোকগমন করেন।
মহারাজা রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Rajrajendra Narayan (১৯১১-১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দ)
কোচ রাজাদের মধ্যে যে কয়জন স্বল্পায়ু ছিলেন তাদের মধ্যে মহারাজা রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ একজন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিলে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর সুশিক্ষিত সুপুরুষ গম্ভীর প্রকৃতির যুবরাজ রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনে বসেন। রাজ্য ভার গ্রহণ করে তিনি যে ঘোষণাপত্র প্রচার করেন তার মধ্যে রয়েছে তার স্পষ্ট মানসিকতা। রাজ্যের দেওয়ানকে প্রতিক্রিয়াশীল মনে করায় ২৪ ঘণ্টার নোটিশে রাজ্য ছাড়া করেন। মহারাজ রাজেন্দ্র পিতার আদর্শকে অনুসরণ করতেন। তিনি মোহনবাগান ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কোচবিহারে এই রাজার নামে একটি রাস্তার নাম রাখা আছে।
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Jitendra Narayan (১৯১৩-১৯২২ খ্রীষ্টাব্দ)
অবিবাহিত অবস্থায় জ্যেষ্ঠভ্রাতা পরলোক গমন করলে অনুজ জিতেন্দ্র নারায়ণ সিংহাসনে বসেন। রাজা হবার কয়েকদিন পূর্বে তিনি বড়দার গায়কোয়াড় বিদুষী রাজকন্যা ইন্দিরা দেবীকে ইংল্যান্ডে বিয়ে করেন। মহারাজ কুমার ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণ ও হিতেন্দ্র নারায়ণকে উচ্চতম রাজকার্যে নিয়োজিত করেন। তিনি কোচবিহার শহরের বৈদ্যুতিকরণ, পানীয় জলের ব্যবস্থা, টেলিফোন ব্যবস্থায় মনোনিবেশ করে নাগরিক জীবনকে উন্নতিকরণের সক্রিয় ছিলেন। এছাড়া নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও পশুস্বাস্থ্য রক্ষায় তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি পিতার ন্যায় পশুশিকারে আগ্রহী ছিলেন।
তুফানগঞ্জ নৃপেন্দ্র নারায়ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল তার সময় স্থাপিত হয়েছিল। ইলাদেবীর নামানুসারে তুফানগঞ্জ মহিলা গার্লস হাই স্কুল এবং গায়ত্রী দেবীর নামে একটি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। স্বর্গীয় পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা ,মেখলিগঞ্জে স্মৃতি ভবন অথবা পাঠাগার নির্মাণ করেন। ত্রিপুরার রাজভ্রাতার সঙ্গে জ্যেষ্ঠ কন্যা ইলা দেবীর বিয়ে হয়, দ্বিতীয় কন্যা গায়ত্রী দেবীর বিয়ে হয় জয়পুরের রাজা দ্বিতীয় সওয়াই মান সিংহের সঙ্গে ১৯৪০ সালে। মেনকা দেবীর বিয়ে হয় মহারাজ যশবন্ত রাও এর সঙ্গে। তিনি নৃপেন্দ্র নারায়ণ এর মর্মর মূর্তি স্থাপন করেন। তিনি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন লর্ড কারমাইকেন এর নামে।
মহারাজের দুই পুত্র ও তিন কন্যা ছিল। বিবরণ –
পুত্র – ১) জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ
২) ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ
কন্যা -১) ইলা দেবী ২) গায়ত্রী দেবী ৩) মেনকা দেবী
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ২০ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডে রোগা্ক্রান্ত হয়ে অকালে পরলোক গমন করেন। মহারাজের জন্ম এবং মৃত্যু একই তারিখে।
মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Jagaddipendra Narayan (১৯২২-১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দ)
শিববংশ মহারাজ বিশ্ব সিংহ দিয়ে কুচবিহারে যে রাজত্বের শুরু, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতভুক্তির মাধ্যমে এই রাজ্যের অবসান ঘটে ২২ তম মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বের সময়ে। একটি বংশের ৪৫০ বৎসরের উপর একটানা রাজত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে নেই যা কোচবিহার রাজবংশে সম্ভব হয়েছে। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর বর্তমান কুচবিহার রাজপ্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। শৈশবে জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ গৃহশিক্ষক অশ্রুমান দাশগুপ্তের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। মাত্র আট বছর বয়সে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ সিংহাসনে আরোহন করায়, রিজেন্সি কাউন্সিলের দ্বারা শাসন পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। রাজমাতা ইন্দিরা দেবী এই কাউন্সিলের সভানেত্রী হিসেবে কাজ কর্ম পরিচালনা করতেন। ১৯২৩ সালের ২১ মে রিজেন্সি কাউন্সিল গঠিত হয়। এরপূর্বে পর্যন্ত স্টেট কাউন্সিল সবকিছু তদারকি করতো। ১৯৩৬ সালের ৬ এপ্রিল মহারাজের ২১ বৎসর পূর্ণ হলে সেই সময় গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন কর্তৃক এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতা পরিচালনার ক্ষমতা পান। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ স্বহস্তে রাজ্য শাসন গ্রহণ করার পর প্রায় প্রত্যহ কুচবিহার শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে সকালবেলায় ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে ঘুরে শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পরিদর্শন করতেন। তার সঙ্গে ছোটভাই ইন্দ্রজিৎ, ছোট বোন গায়ত্রী দেবী ও খুড়তুতো ভাই গৌতম নারায়ণ থাকতেন।
মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ধীর, স্থির, গুণীজনের গুনগ্রাহী, প্রজাদরদী ও সুবিচারক ছিলেন। তিনি কুচবিহারে থাকলে প্রতি শুক্রবার সকাল এগারোটা থেকে প্রজাদের অভাব,-অভিযোগ, আবেদন-নিবেদন শুনতেন এবং প্রয়োজনমতো অতি শীঘ্র তার প্রতিকার করতেন।
মহারাজা খেলাধুলা খুব ভালোবাসতেন এবং নিজেও খেলতেন। ক্রিকেট ফুটবল ব্যাডমিন্টন খেলায় পারদর্শী ছিলেন। ১৯৪৩-৪৪ সালের রঞ্জি ক্রিকেট ফাইনালে তিনি ছিলেন বাংলা দলের অধিনায়ক। ক্রিকেট প্রভৃতি খেলায় কোচবিহার কাপ জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলি এখনো তার স্মৃতি বহন করেছে। পোলো খেলার মাঠ কে তিনি বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করেন। এই মাঠ পরবর্তীতে যুদ্ধের বিমান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মহারাজা ছিলেন একজন সুদক্ষ পাইলট। ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দ ৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সরকার জগদীপেন্দ্র নারায়ণকে সাম্মানিক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সম্মানিত হতে থাকেন। ১৯৭০ সনে ১১ই এপ্রিল কলকাতায় কুচবিহারের শেষ মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ দেহত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে পৃথিবীতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক রাজবংশের অবসান হলো। মহারাজের কোন সন্তানাদি না থাকায় অনুজ ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণের পুত্র বিরাজেন্দ্র নারায়ণ মুখাগ্নি ও শ্রদ্ধাদি ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করেন।
জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের বিদায় শুভেচ্ছা
কুচবিহার রাজ্য ভারত ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্তি হওয়ার সময় কুচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ তার প্রজাবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে যে বিদায় শুভেচ্ছা ঘোষণা করেছিলেন তা নিম্নরূপ –
On this solemn occasion which marks the end of long and Happy association, my mother and I send you our best wishes, my beloved people.
Wherever we may be, we shall never forget you, your loyalty and your devotion, we hope you will always maintain the peace, goodwill and harmony which has been common heritage.
We shall always watch with keen interest your moral and material welfare and always pray for your happiness and prosperity.
May god almighty bless you all.
Jagaddipendra Narayan.
মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণ / Maharaja Birajendra Narayan (১৯৪৪-১৯৯২ খ্রীষ্টাব্দ)
কুচবিহারের মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ ও ঈশরাণী কমলা দেবীর ( ইনি দক্ষিণ ভারতের পিঠামপুরোমের রাজকন্যা ) পুত্র সন্তান হিসেবে কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে জন্মগ্রহণ করেন, বর্তমানে রাজস্থান রাজ্যের কোটা জেলার মহারানী উত্তরা দেবী হলেন কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণের দিদি।
কুচবিহারের শেষ স্বাধীন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর ১৯৭০ সালের ১১ই এপ্রিল কলকাতায় অলিপুরের ৪নং পার্ক রোডের বাসভবনে পরলোক গমন করেন , এরপর মৃত মহারাজার দেহ বিমানে করে কোচবিহারের রাজপ্রাসাদে আনা হয়। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর ও মহারানী জীনা নারায়ণের কোনো সন্তান না থাকায় জয়পুরের মহারানী ও কুচবিহারের তৎকালীন রাজকন্যা গায়েত্রী দেবীর ইচ্ছা অনুসারে কুচবিহার রাজবংশের লোকেরা মৃত মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের আপন ভাই স্বর্গীয় রাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণের একমাত্র পুত্র সন্তান কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণকে কুচবিহারের পরবর্তী রাজা করতে অনুমতি দেন। এরপর রাজপুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষে রাজসিংহাসনে মুকুটহীন ও রাজত্বহীন রাজারূপে বিরাজেন্দ্র নারায়ণকে রাজ্যভিষেক করা হয়। পূর্বে নতুন মহারাজার নামে মুদ্রা প্রকাশের রীতি ছিল কিন্তু, এই সময় করা হয়নি।
জয়পুরের তৎকালীন মহারাজা দ্বিতীয় সোয়াই মানসিংহ দিল্লী থেকে মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণের স্বীকৃতি পত্র নিয়ে এসেছিল কারণ তা না হলে মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণের রাজন্যভাতা বন্ধ হয়ে যেতো। এরপর নতুন মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণের আদেশে মৃত মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের দেহ কুচবিহার শহরের রানী বাগানের পাশে তোর্সা নদীর তীরে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়, এবং মুখাগ্নি করেন ভাইপো মহারাজা বিরাজ নারায়ণ।
কুচবিহারের মহারাজা হিসেবে বিরাজেন্দ্র নারায়ণের সময়কাল সুখের ছিলো না, ব্যক্তিগত জীবনও সুখের হয়নি। কুচবিহারের সাথে তিনি খুব একটা সম্পর্ক রাখেনি। ১৯৭২ সালে মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণ কলকাতা নিবাসী সামরিক অফিসারের কন্যা মহারানী দেবযানী দেবীকে বিবাহ করেন, অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।এরপর মহারাজ বিরাজেন্দ্র নারায়ণ সুরেখা গুরুং কে বিবাহ করেছিলেন। গত ১৯৯২ সালের ১১ই আগস্ট কলকাতায় কুচবিহারের শেষ মুকুটহীন, রাজত্বহীন রাজ্যের মহারাজা বিরাজেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু ঘটে, এরপর ১৯৯২ সালেই ২৮ আগস্ট তাঁর চিতাভস্ম কুচবিহারে এনে কেশব আশ্রমে (রানী বাগানে ) এনে রাখা হয়, এবং মদনমোহন বাড়িতে কোচ রাজবংশের রীতি মেনে অনুষ্ঠান হয়।
তথ্যসূত্র: রমনী মোহন বর্মার কোচ রাজবংশের ইতিহাস। রঞ্জিত দেবের কুচবিহারের ঐতিহ্যময় রাজপ্রসাদ। খা চৌধুরী আমানত উল্লাহ খানের কোচবিহারের ইতিহাস। ড: নৃপেন্দ্রনাথ পালের ইতিকথায় কোচবিহার। হিমাদ্রি শংকর ভট্টাচার্য্য কুচবিহারের রাজবংশীবলী ও বর্তমান রাজপ্রাসাদ ও বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত।
ছবি :দরং বংশাবলীর পুথি থেকে প্রাপ্ত।
NB: বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন আমার সহকর্মী অভিজিৎ দাস মহাশয় ও অত্যন্ত স্নেহের ভাই আবির ঘোষ।
লিখেছেন: কুমার মৃদুল নারায়ণ
----------------
# Lokhai Raja, Maharani Debjani Devi, Queen Surekha Gurung, Kabiraja of Coochbehar