চিকনা - কামতার প্রথম রাজধানী। Capital Chikna

VSarkar
0
চিকনা রাজধানী কামতা

কামতা/বেহার/কুচবিহার-কোচবিহার সাম্রাজ্যের/রাজ্যের প্রথম আবাস/রাজধানী চিকনা। (ইতিহাসের বুদবুদ)

Writter: Kumar Mridul Narayan

রাজধানী চিকনা র ইতিহাস / History of Chikna

কামতা / বেহার / কুচবিহার – কোচবিহার রাজ্যের প্রথম রাজধানী চিকনা (Chikna, First and old capital of Kamata Coochbehar – Kochbuhar ). (মৃগয়া কালে একখণ্ড বাঁশের ‘চিকনি’ (কঞ্চি) বিপরীতভাবে মৃত্তিকায় প্রথিত করিয়া তাহাকে ভগবতী কল্পনায় বিশু পূজা করিয়াছিলেন এবং তার জন্যই উক্ত স্থান চিকনা নামে প্রসিদ্ধ লাভ করিয়েছিল। মতান্তরে হরিদাস মন্ডলই “চিকনা” নগর স্থাপন করেছিলেন – খাঁ চৌধুরী আমানত উল্লাহ আহমদ, কোচবিহারের ইতিহাস, পৃষ্ঠা নং-৯০)।

কুমার মৃদুল নারায়ণ, কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ, রতন বর্মা, কুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ, ডঃ নরেন্দ্রনাথ রায়

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের আক্রমণে ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে কামতানগরের খেন সাম্রাজ্যের অবসান হয় এবং তাদের রাজধানী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খেন রাজত্বের অবসান এর ফলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুরু হয় চরম অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা। দক্ষ প্রশাসক বা শাসকের অভাব ভীষণভাবে অনুভূত হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতে অনেক ছোট ছোট সামন্ত রাজ্য তৈরি হয় এবং সমস্ত সামন্ত রাজাগণ একত্রিত হয়ে বিদেশি শাসকদের বিতাড়িত করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হন। কেন্দ্রীয়ভাবে রাজা নির্বাচিত হন  হরিদাস মণ্ডল বা হাঁড়িয়া মন্ডল (Haridas Mandal or Haria Mandal)। “গন্ধর্বনারায়নের বংশাবলিতে”এর স্বপক্ষে যুক্তিও পাওয়া যায় – 

“হারিয়াক আনি সবে মন্ডল পাতিলা।

 সেইদিন ধরি তৈতে অধিকারী ভৈলা।।”

হারিয়া বা হরিদাস মণ্ডল তার রাজত্বকালে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন চিকনায় (Chikna)। বলা যেতে পারে চিকনা নগরী (Chikna Nagar) হরিদাস মণ্ডল কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল ।মধ্যযুগে উত্তর-পূর্ব ভারতের এই ছোট রাজ্যটির সীমানা ছিল বর্তমান আসাম ভুটান সীমান্তবর্তী তৎকালীন গোয়ালপাড়া জেলা ও বর্তমান কোকড়াঝাড় জেলার  পূর্বের চম্পাবতী নদী (Champabati River) এবং পশ্চিমে সরলডাঙ্গা (Saraldanga river) বা গোরং নদীর মধ্যখানে। এর উত্তরে ভুটানের পাহাড়ের নিম্নাঞ্চল এবং দক্ষিনে ব্রহ্মপুত্র নদী। চিকনাকে অনেক সময় চিকিনা (Chikina) নামেও বলা হয়। হারিয়া মন্ডল ওরফে হরিদাস মন্ডল তার যোগ্য উত্তরসূরী বীর বিক্রম  তথা মহাদেবের বরপুত্র বিশ্বসিংহকে রাজ্যের শাসন ভার অর্পণ করেন।

See Images

চিকনারাজ বিশ্বসিংয়ের ( King Biswa Singha) অভিষেককালে প্রাচীন রীতি অনুসারে ব্রাহ্মণগণ তাকে রাজোচিত বিশ্বসিংহ নাম ও উপাধি প্রদান করলেন। তার  অভিষেক সু-সম্পন্ন হয় চিকনা প্রাসাদে। চিকনা পর্বতের আটটি গ্রামের অধিপতি তুরকা কোটোয়াল এর সঙ্গে বিশ্ব সিংয়ের যুদ্ধ হয়েছিল এবং যুদ্ধে তুরকা কোতোয়াল  পরাজিত হয়। অভিষেক কালে বিশ্ব সিংহের  মাথায় ছত্র ধারণ করেছিলেন তাঁর অনুজ ভ্রাতা শিষ্যসিংহ। শাসনভার গ্রহণ করার পর মহারাজা বিশ্বসিংহ কামতানগরীর বিশৃংখলা, অরাজকতার সুযোগে কামতা নগরী আক্রমণ করলেন এবং এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা, ব্রম্মপুত্রের উভয়কূলের ছোট ছোট রাজ্য, ডুয়ার্সের অনেকাংশ তিনি ও তার ভাই দখল করে নিতে সফল হলেন। এমনি করেই অল্পকালের মধ্যে তার রাজ্যের পরিধি বিস্তৃতি লাভ করে। কামতানগরীর অধিপতি হিসেবে তিনি “কামতেশ্বর” (Kamateshwar) উপাধি ধারণ করলেন এবং তার শাসনকালে এই অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিবস্থা ফিরে আসে। স্বর্ণ যুগের সূচনা হয় কামতানগরে।

চিকনা দূর্গ / Chikna Fort

হারিয়া মন্ডল নির্মিত পাহাড়ি  চিকনা দুর্গ (Chikna Fort) যা পরবর্তীকালে বিশ্বসিংহের দুর্গ নামে পরিচিত ছিল। কোকরাঝাড় জেলার উলটাপানি (Ultapani) গ্রামের চিকনাঝাড়ের (Chiknajhar) দুর্গটি ভুটান যুদ্ধের জন্য মাঝেমাঝে শিরোনামে এসেছিল। বিশ্বসিংহ তার মায়ের আদেশে তার রাজধানী চিকনা থেকে সমতলে স্থানান্তরিত করেছিলেন হিঙ্গুলাবাসে (Hingulabas) (রাজোপাখ্যান, দেব খন্ড, নবম অধ্যায়)। হিঙ্গুলাবাস বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলার মহাকালগুড়ি গ্রামে ছিপড়া ফরেস্টে অবস্থিত। আবার এও আমরা ধরে নিতে পারি, বর্ধিত রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার সুবিধার জন্য তার রাজ্যে এক প্রান্তে থাকা রাজধানী চিকনা (Capital Chikna) পরিত্যাগ করে সমতলে নিয়ে এসেছিলেন। রাজ্য শাসনের বাস্তব কারণের জন্যই তিনি রাজধানী পরিবর্তন করেছিলেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরলডাঙ্গা এবং চম্পাবতী নদীর মাঝখানে চিকনা নগরীর ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান রয়েছে।চিকনানগরীর  চারপাশে সোনাবাড়ি, মহাদেব, বামনকিল্লা, বাঁশবাড়ি, শিকারপুর এবং নয়াগড় নামক স্থানগুলিতে এখনো কোথাও কোথাও দুর্গের চিহ্ন দেখা যায়। কয়েকশো বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও ইতিহাসের নিদর্শন এবং জ্বলন্ত প্রমাণ গুলি বলে দেয় কামতা / কুচবিহার রাজবংশের গৌরব। এই গৌরবকে বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ না হলেও ও এই চিহ্নগুলি কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। 

৫০০বছর পূর্বের  নিজের পূর্বপুরুষের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক জায়গা ও তার নিদর্শন গুলি স্বচক্ষে দেখার সুযোগ ও সেখানে অবাধ বিচরণ দারুন অনুভূতি। প্রত্যেকটা মুহূর্ত শরীর এবং মনে শিহরণ জায়গায়।ঘন জঙ্গল ও বন্য পশু পাখির ভয় থাকলেও কোন বাধাই আমাদের আঁটকাতে পারেনি। প্রায় ৫ কিলোমিটার জায়গা No man’s land এ যেভাবে আমরা কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে এসেছি সচরাচর  এটা সম্ভব নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তৎকালীন চিকনা বা চিকনাঝাড়ের উপাদান গুলি অনেক কিছুই বলতে চায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ দুয়ার, পরিখা ও ধ্বংসাবশেষগুলি বলে দেয় তৎকালীন দুর্গের নিরাপত্তা ও মহারাজার পরিকল্পনা। একটি তুলসী গাছের পাঠ এখনো বর্তমান। তবে এখানেও লক্ষণীয়ভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। তুলসী পাটের পাশে একটি মূর্তি নির্মাণ করে মূল ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এই এলাকাটি BTC (Bodoland territorial Council ) এর অধীনে। এলাকা দখল নিয়ে কেউ যদি ইতিহাস বিকৃতি করে নিজের মতো করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায় তাহলে সেটা কারোর পক্ষে মঙ্গল নয়।

See image ইতিহাস বিকৃত করার অপপ্রয়াস

চিকনা নামটি প্রাচীন কিছু বইয়ের লিপিবদ্ধ থাকলেও এই জায়গা সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। ৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে আলিপুরদুয়ার জেলার বারোবিশা অতিক্রম করে সংকোশ নদী পার করে আসামে প্রবেশ করতে হবে।সেখান থেকে একই রোড ধরে গোঁসাইগাঁও, কচুগাও, শেরফানগুড়ি (Serfanguri) হয়ে বাইশমুড়ি যেতে হবে। সেখান থেকে সোজা উত্তরে ২৫ কিলোমিটার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে উল্টাপানি, সরলপাড়া চেকপোস্ট পাড় করে একটি বিশাল ব্রাহ্ম মন্দিরে (এটি আদতে শিব মন্দির ) যেতে হবে। সেখান থেকে পশ্চিমে ছোট রাস্তা ঘন জঙ্গল পাড় করে মূল গন্তব্যস্থলে যেতে হবে।চলার পথে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং স্থানীয় লোকেরা এ বিষয়ে খুবই সাহায্যকারী।

অদৃশ্য, অন্তরালে থাকা প্রাচীন এই চিকনা নগরীর নিদর্শন জনসমক্ষে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে এবং এর সঠিক  ইতিহাসও মানুষকে জানানোর দায়িত্ব আছে। এই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বা আসাম সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগ নিলে ভালো হয়।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)