কামতা, বেহার, কুচবিহার সাম্রাজ্যের রাজধানী ও প্রাচীন প্রাচীর গড় – এক অবহেলিত ইতিহাস।
হিঙ্গুলাবাস (Hingulabas) নামটি নতুন প্রজন্ম বা অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমতলে প্রাচীন কুচবিহার সাম্রাজ্যের সৃষ্টির ইতিহাস। ডুয়ার্সের এই অঞ্চল আজ জঙ্গল, পাহাড় প্রকৃতির দ্বার খুলে দিলেও প্রায় পাঁচশত বছর আগে কুচবিহার সাম্রাজ্যের প্রথম মহারাজা বিশ্বসিংহ (বিশু) তার মায়ের আদেশে রাজধানী পার্বত্য চিকনাঝাড় থেকে কামতা নগরের সমতলভূমি হিঙ্গুলাবাসে (Hingulabas – Capital of Kamata Kingdom) (রাজোপাখ্যানে উল্লেখিত) স্থানান্তরিত করেন।
হিঙ্গুলাবাসের বৃন্তান্ত সম্পর্কে “মহারাজ বংশাবলিতে” বর্ণনা আছে–“ভগবতি কপালের সিন্দুর দ্বারা প্রসাদ প্রাচীর হেঙ্গুল বরণ করিয়াছে, এহেতু হেঙ্গুল আবাস খ্যাত হইল”। খা চৌধুরী আমানত উল্লাহ আহমেদ ” কোচবিহারের ইতিহাস” প্রথম খন্ড, ১৯৩৬ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মহাকালগুড়ির (Mahakalguri) নিকটে হিঙ্গুলাকোটের ধ্বংসাবশেষ এখনো প্রদর্শিত হইয়া থাকে”। এই অঞ্চলে আসা ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইউরোপীয় ইংরেজ ব্যবসায়ী পর্যটক রালফ ফিচ (Ralf Fitch) তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে এই অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত তিনি হিঙ্গুলাবাসের নাম উল্লেখ না করলেও প্রধান বন্দরের নাম উল্লেখ করেছেন Cacchegate বা চেচাখাতা (Chechakhata), পরবর্তীতে আরেক ইতিহাসবিদ ব্লকম্যানও চেচাখাতাই মনে করেন। যদিও এ প্রসঙ্গে তার উল্লেখিত চেচাখাতার সঙ্গে রালফ ফিচের চেচাখাতার অবস্থানগত পার্থক্য ছিল।
প্রসঙ্গত হিঙ্গুলাবাস ও চেচাখাতা দুটোই পাশাপাশি অবস্থিত। রাজধানীর সঠিক স্থান নির্ধারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে রাজধানীর নাম বা রাজধানীর অবস্থানের জায়গার সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও এটা নিশ্চিত ডুয়ার্সের ওই গভীর অরণ্যে একসময় জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। হাতি, ঘোড়া, সৈন্য, দুর্গ, মহারাজাদের বীরত্ব প্রদর্শিত হতো রাজধানী হিঙ্গুলাবাসে।সমগ্র কামতনগরের (Kamata Nagar) নীতি নির্ধারণ করা হত এই রাজধানীর দরবারে। এক কথায় এই বিশাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল। মহারাজা নরনারায়ণের রাজ্যভিষেকও হয়েছিল এই রাজধানীতে। এখান থেকেই তিনি ও তার ভাই চিলারায় একের পর এক রাজ্য জয় করেছিলেন এবং রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। প্রজাবৎসল মহারাজা নরনারায়ণের সময় কুচবিহার সাম্রাজ্যের সীমা পরিধি সবথেকে বেশি ছিল। স্বাভাবিকভাবে বোঝাই যায় তার রাজধানী হিঙ্গুলাবাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতখানি ছিল।
অনুমান করা যায় মহাকালগুড়ি সন্নিকটে রায়ডাক ১নং ও রায়ডাক ২ নং নদীর মাঝামাঝি অঞ্চলে ছিপড়ার (Chhipra) গভীর জঙ্গলে বিশ্বসিংহ প্রতিষ্ঠিত রাজধানী হিঙ্গুলাবাসের অবস্থান। মহারাজারা রাজধানীর নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে মাটির গড়, প্রতিরক্ষা প্রাকার বা প্রাচীর নির্মাণ করেন রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান ও তিব্বতি সৈন্যদের আক্রমণ ও রাজধানীকে সুরক্ষিত করার জন্য এই গড়গুলি নির্মাণ করা হয়েছিল এটাই অনুমান।
রায়ডাকের বিধ্বংসী বন্যায় ও ভূমিকম্পে হিঙ্গুলাবাস এর রাজধানী বন্দরের ব্যাপক ক্ষতি হলে মহারাজা নরনারায়নের পুত্র মহারাজা লক্ষীনারায়ণ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে গেলেও প্রাচীন এই সাম্রাজ্যের স্মৃতিগুলি এখনো ছিপড়ার জঙ্গলে বর্তমান। ইতিহাস সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাটির প্রাকার সেই গড়গুলি। যা আজ গোলঢিবি নামে এলাকায় পরিচিত। ক্রমান্বয়েই এই ঢিবিগুলি কেটে সমতল করে তৈরি হচ্ছে বাড়িঘর, চাষের জমি ইত্যাদি, হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের স্মৃতিগুলি। হয়তো এটাই চায় বা ইতিহাসকে আড়াল করার এটাই একটা সঠিক পদক্ষেপ বলে মনে করেন…..(?)
আজ কুচবিহার রাজবংশের রাজপ্রাসাদ বা রাজধানী বললে সকলেই এক কথায় বর্তমান রাজপ্রাসাদকেই মনে করেন। কিন্তু এই রাজবংশের রাজধানীর বিস্তৃতি ছিল বহুদূর পর্যন্ত। বিভিন্ন কারণে রাজধানী পরিবর্তন হয়ে গেলেও পূর্বতন রাজধানীগুলির গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়।মা ভবানী বা বড় দেবীর পূজায় হোক বা রাসমেলার প্রচলনই হোক বা বিভিন্ন দেবদেবালয় নির্মাণই হোক বা একটানা নিরি বিচ্ছিন্নভাবে ৪৫০ বছর রাজ্য শাসনই হোক রাজধানীগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পূর্বতন রাজধানী গুলি কংক্রিটের না হলেও ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্য গুলি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে কুচবিহার রাজবংশের আরো অনেক গৌরব গাথা জনসমক্ষে প্রকাশ পেতো। প্রশ্নটা হচ্ছে কেন এটা করা হবে বা করা হবে না? উত্তরটা স্বাভাবিকভাবে অনুমেয়, সঠিক তথ্যগুলি জনসমক্ষে আসলে প্রচলিত ইতিহাসের সঙ্গে আসল ইতিহাসের পার্থক্য ধরা পড়ে যাবে।সেজন্যই হয়তো পুরাতত্ত্বিক বিভাগ, গোসানিমারি রাজপাট ঢিবি বা চিলা রায়ের কোটের অনুসন্ধান ও খননকার্য শুরু করেও বন্ধ করে দিয়েছে বা দেওয়া হয়েছে। মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে সঠিক ইতিহাস।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানী হিঙ্গুলাবাসের (Hingulabas) অনুসন্ধান বা এর পুরাতাত্বিক গুরুত্ব এতদিন না দিলেও অবশিষ্ঠাংশ স্থাপত্যে নিদর্শন অনুসন্ধিতসু গবেষকরা বা ইতিহাসবিদরা চাইলে এর ইতিহাস উন্মোচন করতেই পারে। ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
ছিপড়ার গভীর ঘন অরণ্যে হিঙ্গুলাবাস অবস্থিত হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারিনি। তবে আগামীতে অবশ্যই যাবো। চাক্ষুষ দর্শন করেছি শামুকতলা বাজারের ৩ কিলোমিটার উত্তরে হাতিপোতা রোডে ধার্সি নদীর তীরে একদা প্রতিরক্ষা দ্বারের ২৫-৩০ফুট গোলঢিবিগুলি। বাশ ঝার, সুপারি বাগান, দিঘি বেষ্টিত প্রাচীর যা বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলার ইতিহাস বিজড়িত আমার পূর্বপুরুষদের স্মৃতি চিহ্নে দাঁড়িয়ে থাকার মর্মস্পর্শী অনুভূতি বলে বোঝানো যায় না। এই অনুভূতির ভাগ হয় না।শিহরণ জাগে রন্ধে রন্ধে।
সফরসঙ্গী প্রিয় ভাই Abir Ghosh