চন্ডী মন্দির - চাপড়েরপাড়, আলিপুরদুয়ার। Chandi Mandir , Chaporerpar

VSarkar
0
Chandi mandir chaporerpar

দেবী চন্ডী ও চণ্ডীর ঝাড় / Chandi Mandir

Writer: Kumar Mridul Narayan

(সমতলে বিশ্ব সিংহের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার এক অনালোকিত ইতিহাস)

কোন একটি অঞ্চলের স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাস ও অন্তপ্রকৃতি জানার ক্ষেত্রে দেবতা বা প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শনগুলি  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় বিশ্বাস, পূজা-পার্বণ, মেলা, উৎসব আচার-আচরণ ও লোকগাথার মাধ্যমেও উক্ত অঞ্চলের ইতিহাসও জানা যায়। এরকমই আলিপুরদুয়ার (Alipurduar) জেলার চাপড়েরপাড় (Chaporerpar) ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় শতাব্দী প্রাচীন চন্ডী মন্দির (Chandi Mandir) ও দেবী চণ্ডীর (Devi Chandi) এই অখ্যাত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠার কাহিনী কোন এক রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এই দেবী প্রতিষ্ঠার আড়ালে লুকিয়ে আছে কামতা /কুচবেহার / কুচবিহার / কোচবিহার সাম্রাজ্যের/ রাজ্যের সমতলে (কামতা অঞ্চলে) দীর্ঘ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতার এক অপরাজেয় কাহিনী।

চন্ডী মন্দির চাপরের পাড়

একদিকে খেন সাম্রাজ্যের পতন, কামতা অঞ্চলে নেতৃত্বের অভাবে অরাজকতা, অন্যদিকে হোসেন শাহের আগ্রাসন এই অঞ্চলকে এক চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে কামতা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ তার মায়ের আদেশে চিকনা পাহাড় থেকে সমতল ডুয়ার্স এলাকার হিঙ্গুলাবাসে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং কামতা অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং রাজ্য পুনরুদ্ধারের  সংকল্প নেন। স্বাভাবিকভাবেই মহারাজা বিশ্ব সিংহকে সম্মুখীন হতে হয় হোসেন শাহের সৈন্যবাহিনী সামনে। উত্তরের চেকো নদী,পশ্চিমে কালজানি ও পূর্বে গদাধর নদীবেষ্টিত এলাকায় দূর্গ নির্মাণ করে এই অঞ্চলে দখলদারি ও রাজস্ব আদায়  করছিলেন হোসেন শাহের সেনাপতি তুর্কা খান। বিশ্ব সিংহ রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে অগ্রসর হলে যুদ্ধ অবশ্যাভাম্বী হয়ে যায় তুর্কা খানের সঙ্গে এবং এই মহাযুদ্ধে বিশ্ব সিংহ হত্যা করেন তুর্কা খানকে। যে তরবারি দিয়ে বিশ্ব সিংহ তুর্কা খানকে হত্যা করেন সেই তরবারিকে দেবী চণ্ডীর উদ্দেশ্যে স্মরণ করে বলেন, মা চন্ডী আমাকে এই যুদ্ধে সহায়তা না করলে আমি এই যুদ্ধে জিততে পারতাম না এবং সেই তরবারিকে মাটিতে পুঁতে সেখানেই চন্ডীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং পূজা অর্চনা করেন (মহারাজা বিশ্ব সিংহ এবং মহারাজা নরনারায়ণ ও অন্যান্য মহারাজারা একইভাবে অন্য কোন যুদ্ধে যাত্রা করলে বা কোন শুভ কাজ করলে দেবী ভবানী, মহাকালী, দেবাদিদেব শিবের আরাধনা করতেন)। সেই থেকে  দেবীর নাম অনুসারে ও প্রচুর পরিমাণে বাঁশের ঝাড় বা জঙ্গল থাকায় এই এলাকার নাম হয় চন্ডীর ঝাড়। চন্ডী দেবীর আরাধনা বা প্রতিষ্ঠা এটা স্বাভাবিক বিষয় ছিল কুচবিহার মহারাজাদের। মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণের সময়ও আয়রনী চিতলিয়া গ্রামে চন্ডীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাজির খগেন্দ্র নারায়ন।

চন্ডীর ঝাড়

নদী ভাঙ্গন, বন্যা এবং ভূমিক্ষয়ের ফলে এলাকার ভৌগলিক অবস্থান পাল্টে গেলে মহারাজা বিশ্বসিংহ প্রতিষ্ঠিত মূল মন্দিরের স্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তবে এলাকার বয়স্ক নাগরিকেরা জানান, তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছেন কুচবিহারের প্রথম মহারাজা এই চন্ডী দেবীর প্রথম পূজা করেন। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত এই পূজা চলছে। দেবী চণ্ডীর দুটি প্রাচীন মূর্তি এখনো আছে । একটি আছে চন্ডীরঝাড়ে ও আরেকটি আছে চেকোর চন্ডী মন্দিরে। বিগ্রহ দুটি অনেক পুরনো। কারুকার্য এবং এর শিল্পকলা দেখে মনে হয় বিগ্রহ দুটি তৈরি হয়েছিল ১৮ শতকের দিকে। বিগ্রহ প্রসঙ্গে এলাকার বাসিন্দা তথা আলিপুরদুয়ার কলেজের সম্মানীয় অধ্যাপক Sailen Debnath মহাশয় বলেছেন, It is mainly because of the sculptor’s lack of knowledge in iconography of the Hindu pantheon. Most probably, statues like this one made of sand stone were chiseled and moulded by local artists.  It was widely during the long iconoclastic Islamic period that the statues were made locally. On the other, transportation of a refined statue from far away North India was not possible at a time after the fall of  Kamatapur and before the strengthening of the Koch regime. এছাড়াও তিনি তার বই “Kamatapur: An Unexplored History of Eastern India (650-1498)

Book by Sailen Debnath” এ বিস্তারিত  উল্লেখ করেছেন। 

প্রাচীন এই দেবী চণ্ডী মন্দির ও তার আশেপাশের অনেক ইতিহাস এখনো আমাদের জানার বাকি। দেউড়ি পরিবারটি প্রায় ১০০ বছর ধরে এই মন্দিরে পূজা করে আসছেন।বাৎসরিক পূজা ১১টি গ্রাম মিলে মহাসমারোহে আয়োজন করে।

বিশেষ বিশেষ দ্রষ্টব্য:- দেবী চণ্ডী ও মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, তৎসংলগ্ন এলাকার ইতিহাস বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করব আমার আগামী বইয়ে। 

সফরসঙ্গী বিপ্লব রায় ভাই।

চন্ডীর ঝাড়ের মুদ্রা ভান্ডার

 তারিখ:- ২০/০৪/২০২৩

(১৯৮৬ সালে উদ্ধার হয়েছিল ৭৬৭টি মুদ্রা)

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আলিপুরদুয়ার জেলার চাপড়েরপাড় ১নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় যেখানে মহারাজা বিশ্ব সিংহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চন্ডী দেবীকে (চন্ডী দেবীর নাম অনুসারে এলাকার নাম হয়েছে চন্ডির ঝাড়) সেখানেই ছিল কুচবিহার রাজ্যের অন্যতম মুদ্রা ভান্ডার। শিব ও চন্ডী উপাসক মহারাজা বিশ্ব সিংহ সমতলের রাজধানী স্থাপনের পাশাপাশি, শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই অঞ্চলে। পরাক্রমশালী মহারাজা বিশ্ব সিংহ বহিঃশত্রু আক্রমণ, হোসেন শাহের আগ্রাসন প্রতিহত করে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেবী চণ্ডীর আশীর্বাদে এই অঞ্চলের অধীশ্বর রূপে যে হিন্দু সাম্রাজ্যের সূচনা তিনি করেছিলেন ১৬ শতকের সূচনায় পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নিদর্শনকারী রাজবংশ রূপে নির্বিচ্ছিন্নভাবে ও শান্তিপূর্ণভাবে প্রায় পাঁচশত বছর শাসন করেছিলেন তার উত্তরসুরিরা।তাৎপর্যপূর্ণভাবে একদা রাজধানী হিঙ্গুলাবাসের সন্নিকটে চন্ডীর ঝাড় এলাকাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এখানেই ছিল কুচবিহার রাজ্যের অন্যতম মুদ্রা ভান্ডার।

চন্ডীর ঝাড়ের মুদ্রা
চন্ডীরঝাড় যেখানে মূদ্রা পাওয়া গিয়েছিল

১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের সকালে স্থানীয়  বাসিন্দা রজত রায়, বর্ষীয়ান সুনীল দাস ও চিন্তেশ্বর রায় জমিতে চাষ করতে গিয়েছিলেন। চাষ করতে করতেই তাদের লাঙ্গলের  সামনে চলে আসে একটি তাম্র  নির্মিত ধাতব পাত্র। আশেপাশে যারা জমিতে চাষ করেছিলেন বিষয়টি তাদের নজরেও আসে। খবর পৌঁছে যায় গ্রামে গ্রামে। দলবেঁধে লোকজন এসে খোদাই করে ধাতব পাত্রটি উদ্ধার করে  এবং ওই পাত্রের ভিতরে “যকের ধন”পাওয়া যায়। প্রচুর রুপার মুদ্রা (সুলতানি, মোঘল, ত্রিপুরার মানিক্য দেবের মুদ্রা, নরনারায়ণের মুদ্রা ও আরো  অন্যান্য মুদ্রা ) ছিল ওই ধাতব পাত্রে। নিমেষের মধ্যে খন্ড বি-খন্ড করে ফেল ধাতব পাত্রটি এবং যে যার মত করে মুদ্রা গুলিকে নিয়ে যায়। এই খবর পৌঁছে যায় তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুরদুয়ার থানায়। ততক্ষণে খন্ড বি-খন্ড রুপার ধাতব পাত্রটি এলাকা থেকে বাইরে চলে যায় এবং পাত্রটি নাকি গলিয়ে ফেলা হয়। বেহাত হয়ে যাওয়ার পরেও ৭৬৭টি মুদ্রা উদ্ধার করে আলিপুরদুয়ার থানার পুলিশ এবং বলা চলে এতগুলি মুদ্রা একসঙ্গে এখনো পাওয়া যায়নি। যুদ্ধ জয় ও উপধৌকোন হিসেবে সংগ্রহীত মুদ্রাগুলি রাখা হতো এই মুদ্রা ভান্ডারে।তবে এই এলাকাটিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন কার্য করলে আরো অনেক কিছু উদঘাটন হতে পারে।

বর্তমানে এলাকাটি “গড়ের পাড়” নামে পরিচিত এবং স্থানীয় লোকেদের দাবি ওখানে অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা ওই এলাকাটিকে এড়িয়ে চলে। সাহস সঞ্চার করে ভাই বিপ্লব রায়  নিয়ে চলে গেলাম ঐতিহাসিক এই জায়গায়। 

কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ভাতৃপ্রতীম Rzishikalpa Paul , মুদ্রা বিশেষজ্ঞ Sankar Shanker Bose মহাশয় ও আলিপুরদুয়ার কলেজের সম্মানীয় অধ্যাপক Sailen Debnath মহাশয়।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)