Writer: Kumar Mridul Narayan
প্রত্যেক অঞ্চলের নাম বিশেষণে জায়গার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, থাকে ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্থানীয় অঞ্চলের আর্থসামাজিক বিবরণ, উপকথা এবং জনশ্রুতি। একদা কুচবিহার রাজ্য ঐতিহাসিক বিচারে ও নাম বিশেষণে স্থান নামগুলির প্রভাব বহুল পরিমাণে প্রচলিত এবং কুচবিহারের ইতিহাসে স্থান নামগুলির বিশিষ্ট ভূমিকা আছে।এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান এবং সঠিক গবেষণা করলে এখনও অনেক অজানা তথ্য, অজানা ইতিহাস প্রকাশিত হতে পারে। এরকমই একটি প্রাচীন এলাকা,যাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে একটি বৃহৎ অঞ্চল।
বোকালির মঠ, কোচবিহার (Bokalir Math)
খুবই অনালোকিত একটি প্রাচীন দেবস্থান বোকালির মঠ (Bokalir Math), এই নাম সম্পর্কে একাধিক মতবাদও আছে। “বো”কালি ও মঠ এই শব্দ দুটির মধ্যে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের ভাবনা লক্ষ্য করা যায়। সর্ব ধর্মের পূজারী কুচবিহারের মহারাজাদের রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বরাবরই ছিল। মঠে সাধারণত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা উপাসনা করেন। এছাড়া ভুটিয়াদের এই অঞ্চলে আগমন, আক্রমণ, প্রভাব সবটাই ছিল। এই অঞ্চলের একাধিক মন্দিরে হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়ে পূজা পার্বণের রীতি এখনো আছে।
বোকালির মঠ এর ইতিহাস
যাইহোক বোকালির মঠ সম্পর্কে বা তার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে এখনো সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। যতটুকু জানা যায় বা বর্তমান মন্দির সম্মুখে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট ভগ্ন অংশ দেখে বোঝা যায় অতীতে এখানে একটি মন্দির ছিল এবং পার্শ্ববর্তী বানেশ্বর, সিদ্ধেশ্বরী, মধুপুর, হরিপুর শিব মন্দির সহ একাধিক মন্দির থাকায় প্রাচীন এই মঠেরও গুরুত্ব কোন অংশে কম নয় । হয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরটি মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে।অনুসন্ধান করলে এর সঠিক তথ্য বের হয়ে আসতে পারে। কিন্তু যে ভাবে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপকে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে তাতে করে আরো একটি ইতিহাস অন্ধকারে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে শুধু প্রশাসন নয়, সকল সুনাগরিক, অনুসন্ধিৎসু গবেষক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও স্থানীয়গন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে নকল মন্দির নির্মাণ করার ক্ষেত্রে আমরা যতটা ব্যয় করি তার কিছুঅংশ ব্যয় করলেই আমরা ইতিহাসকে রক্ষা করতে পারি।
এই মন্দির বা মঠের নাম কেন্দ্র করে আজ এলাকার পরিচিতি। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাট-বাজার, চৌপথি, রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদি। নামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্থান আজ অনেক খ্যাতি লাভ করেছে বিভিন্ন বিষয়ে। কিন্তু এর প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচন হয়নি বা মন্দিরের উন্নতি আক্ষরিক অর্থে সেরকম কিছুই হয়নি। জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনরকমে রয়েছে এলাকাটি অনাদরে। এলাকাবাসী চারচালা একটি ঘর নির্মাণ করে মা বোকালীকে প্রতিষ্ঠা করে বাৎসরিক অমাবস্যার সময় শুধু পূজা করে। জন্মাষ্টমী তিথিতে পূজা-পার্বণ হয়। কালীপূজায় বলি পর্ব চলে। শোনা যায় পূর্বে এখানে নাকি নরবলি হত। প্রায় দুই বিঘা এলাকাজুড়ে রয়েছে মন্দির চত্বরটি। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে মন্দিরটি থাকলেও স্থানীয় ভক্ত প্রাণ মানুষজন নিয়মিত দেখাশোনা এবং পূজা-অর্চনা করেন। স্থানীয় বাসিন্দা দীপেন রায় বলেন, পূর্বে এই জায়গাটি তার পিতা শশী রায়ের ছিল। পরবর্তীতে তিনি জায়গাটি হস্তান্তর করেন গ্রাম পঞ্চায়েতকে। তবে এখনও তারা মন্দিরের নিয়মিত পূজা-অর্চনা ও পরিছন্নতা সকলে মিলে করেন।
নিরিবিলি ও শান্ত মনোরম পরিবেশ যুক্ত এই মন্দিরের পরিবেশ। মন্দির প্রাঙ্গণে মহিরুহের মতো দাড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ প্রাচীন ইতিহাসের অনেক কথা কয়। কুচবিহার শহর থেকে উত্তর দিকে বানেশ্বর চৌপতি অতিক্রম করেই বোকালির মঠ চৌপথি থেকে পূর্বদিকে এক, দেড় কিলোমিটার গেলেই এই মন্দিরে পৌঁছে যাওয়া যায়।
মুকুল রায় (Mukul Roy) এর থেকে প্রাপ্ত তথ্য –
বোকালি “সম্বন্ধে একটা কাল্পনিক তত্ত্ব আছে আমার কাছে, জানি না কতটুকু বিশ্বাস করবেন, তবে এটাই সত্যি যে, শশী রায় ছিলেন, একজন তখনকার দিনের সুপরিচিত কীর্তনের ঢুলি (খুবই ওস্তাদ)। দূর দূরান্তর তার পরিচয় ছিল। প্রতিদিনের ন্যায় তিনি, সেই দিনও খুব সকালে উঠেছিলেন, স্নান করেছিলেন, হঠাৎ এক নারী চুল ছাড়া অবস্থায় এসে তার কাছে জল চাইছিলেন পান করবেন বলে, শশী ( দাদু) যখন এক গ্লাস জল এনে তার হাতে দিতে চাইলে,, সেই নারী গেলাস হাতে নেবে না, বলে বলেছিলো,” দূর থেকে উপড় থেকে জল ঢেলে দাও,” সেভাবেই জল দাদু ঢেলে দিয়েছিলো , আর সেই নারী তার দু হাত একসাথে করে জল খেয়ে ছিলো। আর খেয়ে মা বোকালি মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলছিলো কিন্তু এদিকে দাদু যখন দিদিমা কে ডাকছিলো, যে “ওঠ সকাল হয়ে গেছে, দিদিমা উঠে যখন, দাদুর কাছে জানতে চায়, কেন ডাকছিলো, তখন দাদু বলে যে, সকাল হয়ে গেছে ,আজি এত সকালে অচেনা এক নারী চুল ছাড়া অবস্থায় এসে জল খেয়ে গেল। এছাড়া সকালও হয়ে গেছে। দিদিমা হতবাক, বলে কি ? ভোর ও ঠিকঠাক হয় নাই, কিন্তু দাদুর কাছে পরিষ্কার দিন। তখনই বলছিলো, আয় আয় (মন্দিরের) এদিয়ায় গেইল এলায় মহিলা টা। যখন দেখার জন্য দুজনে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই দাদু বুঝতে পারছিলো যে, এখনও সকাল হয়নি, তারপর , তারা ভয়ে জড়সড় হয়ে, আবার ঘুমিয়ে ছিল, আর দুজনে চিন্তা করেছিলো যে, আজ কতবড়ো একটি ঘটনা হয়ে গেল। তারপর সকাল হয়েছিল। এখন ঐ জায়গায় অনেক নতুন বাড়ি হয়েছে, তখন কিন্তু ওখানে একটাই বাড়ি ছিল, সেটা ঐ শশী রায় এর। মা বোকালি ছিল দাদুর একদম ঘড়ের ঠাকুর এর মতো, দৈনিক সেই পূজা দিত, যখন সে ঢোল বাজাত, শুধু তার ঢোল বাজত না, ঢোলই কথা বলত। এছাড়া জায়গাটাও তার পিতার থেকে পাওয়া সম্পত্তি। এখন তো ক্লাব । যাইহোক, “দাদুর বিশ্বাস ছিল যে, মা বোকালি তার হাতে জল খেয়েছিলো।”
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- তথ্যে কোন অসম্পূর্ণতা থাকলে মার্জনা করবেন ও এই মঠ সম্পর্কে অজানা কিছু জানা থাকলে অবশ্যই শেয়ার করবেন।
সফরসঙ্গী প্রিয় ভাই আবির ঘোষ।