ভারতের স্বাধীনতা ও কুচবিহার রাজ্য। Indian independence and Coochbehar State.

VSarkar
0
coochbehar state and india freedom

৭৫তম স্বাধীনতা বর্ষপূর্তি এবং ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসের অগ্রিম শুভেচ্ছা
লিখেছেন কুমার মৃদুল নারায়ণ

“আমরা ভারতীয় হতে পেরে গর্বিত”

পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে আসমুদ্র হিমাচল যখন স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তখন স্বতন্ত্র রাজ্যে কুচবিহার এর ব্যতিক্রম ছিল না। প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতা, দেশপ্রেমিকদের বলিদান, ত্যাগ, ভারতমাতার প্রতি আনুগত্য এই ভূমি  তার সাক্ষী। দাসত্ব থেকে মুক্তি কে না পেতে চায়। রাজশাসিত কুচবিহার ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকলেও (দেশীয় রাজ্য / Princely state কুচবিহার শাসিত হতো মহারাজাদের দ্বারা, শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয়ে – পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা এবং অর্থ ব্রিটিশদের অধীনে ছিল) দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী  বীরদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আশ্রয় দিয়েছিল এবং সাহায্য করেছিল। লড়াই, সংগ্রামের মাধ্যমে বীরত্বের সহিত এই দেশ স্বাধীন হলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে দেশভাগ এবং কুচবিহার রাজ্য -কে (Coochbehar State) পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার একটা  প্রয়াস ছিল। এত কিছুর পরেও ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট কুচবিহার একটি স্বতন্ত্র রাজ্যে থেকে যায় এবং স্বাধীন ভারতের সম্মান ও গৌরবে মেতে ওঠে কুচবিহার রাজ্য। স্বতন্ত্র কুচবিহার রাজ্যের কান্ডারী হিসেবে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর (Maharaja Jagaddipendra Narayan Bhupbahadur) ভারতের জাতীয় পতাকা (National Flag of India) উত্তোলন করেন এবং দেশের স্বাধীনতাকে (Indian independence) অভিবাদন জানান।

স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশ শাসিত ভারত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল Princely India  এবং আরেকটি British India ।কুচবিহার ছিল দেশীয় রাজ্য বা Princely state। যেখানে ভারতীয়দের দ্বারাই ভারতীয়রাই শাসিত হত।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট  ব্রিটিশদের শাসন  থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হলো জনগণের শাসন। প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ছোট-বড় ৫৬৩টি দেশীয় রাজ্য ছিল। দেশীয় রাজ্যগুলি মানদণ্ড আয়তন, জনবল, প্রাকৃতিক বা সামরিক শক্তিতে ভিন্ন ছিল। আবার অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানদণ্ডে, প্রাচীনত্বের বিচারে কেউ কারো সমসংখ্যক বা সমপর্যায়ের ছিল না।কেউ ছিল আয়তনে বৃহৎ, কারও জনবল নগণ্য, কেউবা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, আবার কেউ সামরিক শক্তিতে দুর্বল। কোন কোন দেশীয় রাজ্যে ছিল শতবর্ষ প্রাচীন আবার কোন কোন দেশীয় রাজ্যে ছিল তুলনামূলকভাবে নবীন। জাতিসত্ত্বার ভিত্তিতে দেশভাগ এবং স্বাধীন ভারতের নতুন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট আসমুদ্র হিমালয়ের দেশবাসী স্বাধীনতা উৎসবে মেতে ওঠে। সেদিন রাজশাসিত কুচবিহার রাজ্যেও (Coochbehar State) ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। 

মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ (Maharaja Jagaddipendra Narayan) নিজে সকাল ৮টায় কুচবিহার নীলকুঠির মাঠে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভারতের স্বাধীনতা -র (Indian Independence) প্রতি সম্মান জানান। মিলিটারি, পুলিশ প্যারেড, মার্চপাস্টের অভিবাদনের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবসকে সম্মান জানান হয়। স্বাধীন ভারতের মঙ্গল কামনায় সকল দেবালয়, মসজিদ, গির্জা, ব্রাহ্ম মন্দিরে বিশেষ পূজা, প্রার্থনা হয়। ধর্মসভায় বিশেষ পাঠ  ও কীর্তন এর ব্যবস্থা করা হয়। সারা রাজ্যের বিভিন্ন অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশেষ বিশেষ গৃহে, এমনকি কুচবিহার রাজবাড়ীতে (Coochbehar Royal Palace) পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা শোভিত সমগ্র শহর অপূর্ব রূপ ধারণ করে।

মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র  নারায়ন ভূপবাহাদুর জনগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করেন। ওইদিন বিকাল সাড়ে চারটায় কুচবিহার সাগর দিঘির (Coochbehar Sagar Dighi) দক্ষিণের মাঠে ভারতের স্বাধীনতা উপলক্ষে  এক বিশাল  জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর। কুচবিহার রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী সতীশ সিংহ রায় সরকার (Education Minister of Coochbehar State – Satish Singha Roy Sarkar), আইনসভার সদস্য রায়সাহেব শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র কান্ত মজুমদার (Raisaheb Shri Surendra Kanta Majumder), খান চৌধুরী আমানত উল্লাহ আহমেদ (Khan Chowdhury Amanatullah Ahmed) , ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রত্যেকই সুন্দর বক্তব্য উপস্থাপন করেন মহারাজার সভাপতিত্বে। সন্ধ্যাবেলায় কুচবিহার মিউনিসিপাল মাঠে (Coochbehar Municipal ground) মহারাজার সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয় এবং মহারাজা এখানে একটি সুন্দর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাদান করেন।

সভাপতির ভাষণে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর বলেন – 

আজ ১৫ই অগস্ট ভারতবাসীর কাছে অতি পবিত্র স্মরণীয় দিন। ভারতের স্বাধীনতা দিবসরুপে ইতিহাসে এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। ভগবানের করুণায় ভারতের স্বাধীন আজ আমাদের দীর্ঘ পরাধীনতার অবসান ঘটেছে। পরাধীনতার শৃংখল মোচনের জন্য ভারতবর্ষের কঠোর সাধনা আজ জয়যুক্ত হয়েছে।যেসব দেশ প্রেমিক বীর ভারত সন্তান মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাদের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের কথা আজ আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। পরাধীনতার দুঃখময় দিনে স্বাধীনতা লাভই ছিল আমাদের একমাত্র লক্ষ্য আজ আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছেছি। ভারতের স্বাধীনতা লাভ ভারতের পক্ষে এক মহিমময় নবযুগের সূচনা মাত্র। আজ এই উৎসবের দিনে আমরা যেন আমাদের কর্তব্য ভুলে না যাই। একথা আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচার নয়, স্বাধীনতা দায়িত্বপালন বিচারবুদ্ধি এবং সংযমের দ্বারাই পরিচালিত হয়।

Nilkuthi Jagaddipendra Narayan
মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন নীলকুঠি মাঠে ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্টের সকাল বেলায়। ছবি: সংগৃহীত।

আমি বিশ্বাস করি, ভারতীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতির আদর্শ ত্যাগ ও সংযমের আদর্শ, যা স্বাধীনতার অশেষ গ্লানি ও দুঃখের মধ্যেও ভারতকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। স্বাধীন ভারতের লক্ষ্য ও কর্মপন্থা সেই মহান আদর্শের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।

আমি আশা করি, স্বাধীন ভারতের এই মহাসাধনায় আমাদের এই স্বাধীন কুচবিহার রাজ্য অতি ক্ষুদ্র হলেও তার এক বিশিষ্ট অংশগ্রহণ করবে, কুচবিহারের কল্যাণ এর সঙ্গে ভারতের কল্যাণকে যুক্ত করে নিজেকে সার্থক ও গৌরবময় করে তুলবে।

আজ এই শুভদিনে আমরা সর্বান্তকরণে স্বাধীন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের কল্যাণ কামনা করি।

           – জয় হিন্দ 

তার বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, কুচবিহার রাজ্যে স্বতন্ত্র থেকে ভারতের কল্যাণের সঙ্গেও নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করবে। তার উদারতা ও লক্ষণীয়। তিনি স্বাধীন পাকিস্তানেরও শুভকামনা করেন।

মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ তার বিভিন্ন বক্তব্যে শক্তিশালী ভারত গঠনের পক্ষেই মত প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি ভারতের দিকেই ঝুঁকেছিলেন। দেশীয় রাজ্যের অনেকেই ভারত ডোমিয়নের সংযুক্তিকরণ হতে চাননি। তবে তিনি  চেয়েছিলেন কুচবিহার রাজ্যে একটি পৃথক সত্তা নিয়ে থাকবে। তিনি মনে করতেন, এখানকার নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা,ভাষা, সংস্কৃতি অক্ষুন্ন থাকবে। তার অবর্তমানে তার উত্তরসূরিদের এবং এখানকার অধিবাসীদের নিজস্ব সত্তা বজায় থাকবে। অন্যথায় মিশ্র সংস্কৃতির স্রোতে নিজেদের (কুচবিহারি) সামাজিক অবস্থান হারিয়ে যাবে। কারণ তিনি কখনোই ভাবতে পারতেন না তার পূর্বপুরুষ  বিশ্ব সিংহ প্রতিষ্ঠিত সাড়ে চারশত বছরের প্রাচীন কুচবিহার রাজবংশ কোন প্রদেশ বা জেলার অংশীদার হবে। কুচবিহারের পৃথক সত্তা বা অস্তিত্ব বজায় থাকবে এটাই ছিল তাঁর ইচ্ছে।

স্বাধীনতার প্রাকমুহুর্তে  instrument of accession এর মাধ্যমে  ভারতে ইউনিয়নে যোগদান এবং Stand still agreement অর্থাৎ ভারত ইউনিয়নে যোগ দিলেও নিজেদের আধিপত্য এবং প্রশাসনিক কাঠামো বজায় রাখা। এককথায় কুচবিহারি সত্তা অধিকারের ক্ষেত্র (অনেকটা মিল হায়দ্রাবাদের মূলকী আইনের মতো ) ধরে রাখা।যেমন ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে শুধু কুচবিহারিদেরিই অধিকার ছিল।শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কুচবেহরিদের বিশেষ রক্ষাকবচ ছিল।এরকম আরো অনেক সুযোগ সুবিধা ছিল। স্বাধীন ভারতে  কুচবিহার ভারত ডোমিয়নের  সঙ্গে সংযুক্তি নিয়ে একপ্রকার Tug of War চলেছিল। যাইহোক তোর্ষা  নদী দিয়ে  অনেক জল বয়ে যাওয়ার পরে আজকের দিনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অনেক দেশীয় রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও কুচবিহার রাজশাসিত রাজ্যে ভারত ডোমিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। দেশীয় রাজ্যে কুচবিহার  ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও ভারতের স্বাধীনতাকে যথেষ্ট সম্মান এবং শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এবং মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র  নারায়ণ ভূপবাহাদুর নেতৃত্বে  কুচবিহার একটি স্বতন্ত্র রাজ্যে থেকে যায়।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং বিভিন্ন টানাপোড়েন, সর্বোপরি ভারত সরকারের অনুরোধে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে অগাস্ট ভারতভুক্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ শর্তের বিনিময়ে কুচবিহার রাজ্যের শাসনভার  ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেন।ভারত ইউনিয়নে যোগদানে মহারাজা  জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের অন্যতম শর্ত ছিল কুচবিহারকে “গ” শ্রেণীর রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে। কারণ তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি যে তার পূর্বপুরুষ মহারাজা বিশ্বসিংহ প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ কোন জেলা বা প্রদেশের অংশীদার হবে। মহারাজার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ভারত সরকার চীফ কমিশনার ভি.আই.নানজাপ্পার তত্ত্বাবধানে কুচবিহারকে “গ” শ্রেণীর রাজ্যের  মর্যাদা দেয়। মনিপুর,ত্রিপুরা ও কুচবিহার ভারতে অন্তর্ভুক্তি্র সময়ে “গ”শ্রেণীর রাজ্যের তকমা পায়। মনে রাখা খুবই দরকার, মনিপুর এবং ত্রিপুরার থেকে কুচবিহার নাম, যশ, খ্যাতি, আয়তন, আয় এবং ব্যয়ে  সবদিকে উন্নত এবং বড় হওয়া সত্ত্বেও মনিপুর এবং ত্রিপুরা পৃথক রাজ্যে বা প্রদেশ পেলেও কুচবিহার কি পেল ?

১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়। তারপর ১৯৫৬ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর  দ্বারা  “গ” শ্রেণীর রাজ্যের বিষয়টি সংবিধান থেকে তুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানে দুই ধরণের রাজ্যের ব্যবস্থা আছে-  পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত এখন পর্যন্ত ১০৫ বার ভারতীয় সংবিধান সংশোধন হয়েছে।তারই ফলস্বরূপ আজ আমাদের দেশের ২৯টি অঙ্গরাজ্য। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র ভূপবাহাদুর যে পৃথক সত্তা বা স্বতন্ত্রের কথা বলেছিলেন তা সংবিধানের ৩নং ধারায় উল্লেখ আছে ।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)