কুচবিহার রাজবংশের শাখা বিজনী রাজপরিবার, চিরাং জেলা। Bijni Royal Family – Chirang District
Writer: Kumar Mridul Narayan
কুচবিহার রাজবংশের অন্যতম শাখা বিজনী রাজপরিবার (Bijni Royal Family), চিলা রায়ের পৌত্র পরীক্ষিত নারায়ণের উত্তরসূরীরা আসামের চিরাং জেলার বিজনীতে তাদের অবস্থান। বর্তমানে এলাকাটি BTC (Bodoland territorial Council) অন্তর্ভুক্ত। রাজা না থাকলেও রাজপরিবারের ঐতিহ্য গুলি এখনো বিদ্যমান। সূচনালগ্নের দিকে তাকালে দেখা যায় সংকোশ নদীর পূর্ব প্রান্তে মহারাজা নরনারায়ণ তার ভাই চিলারায়কে রাজ্যশাসনের অধিকার দেন। চিলা রায়ের মৃত্যুর পর তার পুত্র রঘুদেব নারায়ন পিতার উত্তরসূরি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করলেও কুচবিহার রাজসিংহাসনে বসতে না পারার জন্য তার মনে একটা ক্ষোভ এবং আক্ষেপ ছিল। তার এই মনোবৃত্তি পিতৃব্যের আনুগত্য ও অনুশাসন বিরোধী ছিল। কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারী তার মনে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংকোষের পূর্বপ্রান্তে নিজেকে স্বঘোষিত রাজাও ঘোষণা করেন। তিনি “ঘিলা বিজয়পুরে” (Ghila Vijaypur) আরো একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন তার জ্যাঠামশাই মহারাজা নরনারায়ণের বিরুদ্ধে। মহারাজ নরনারায়ন তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে শান্ত করার জন্য কুচবিহার থেকে প্রতিনিধি বিরুপাক্ষ কার্যীকে পাঠিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রেও কাজ হয়নি। পরিশেষে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে বা মধ্যস্থতায় স্থিতিবস্হা আসে।
বিজনী, দরং ও বেলতলা রাজবংশ (Bijni, Darang and Beltola Royal Family)
চিলা রায়ের উত্তরসূরিরা আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে (বিজনী, দরং, বেলতলা) তাদের রাজধানী স্থাপন করে ও রাজবাড়ী নির্মাণ করে। চিলা রায়ের বংশধর বিজনী রাজপরিবারের প্রথম মহারাজা বিজিত নারায়ন (Maharaja Bijit Narayan) ১৬৭১ খ্রীস্টাব্দে সিংহাসন আরোহন করেন এবং বর্তমান বিজনী শহরে রাজধানী নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা করেন।সরলতা, অতিথিয়েতা এবং প্রজাপরায়ণ হিসেবে এই রাজপরিবারের খুবই সুখ্যাতি ছিল। তবে এই অঞ্চলে ভুটিয়াদের প্রচন্ড উপদ্রব ছিল। ভুটানের মেচ সর্দার ঝাওলিয়া বারবার আক্রমণ করেন বিজনীর ভূখন্ডে। ভুটিয়া আক্রমণের ফলে বারবার রাজধানী স্থানান্তরিত করতে হয়। এছাড়া মুঘলরাও অনেক বার আক্রমণ করেছিল ।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ভয়াল ভূমিকম্পে বিজনী রাজপ্রাসাদ, গুরুত্বপূর্ণ ভবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো কাঠামো একেবারে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। আবার রাজধানী স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয় বিজনী রাজপরিবার (Bijni Royal Family)। এতদসত্ত্বেও নিবিড় যোগাযোগ এবং সখ্যতা ছিল কুচবিহার রাজপরিবারের সঙ্গে।বিজনী রাজপরিবারের রাজা কুমুদ নারায়ণ এর সঙ্গে কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুরের খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল।কুমুদ নারায়ণকে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন ও পারিবারিক বিতর্কে আইনি পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ক্রমান্বয়ে বিজনী রাজপরিবার দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। রাজপরিবারের একটি শাখা যায় সিদলিতে (Sidli) এবং অপর শাখাটি যায় অভয়পুরীতে (Abhaypuri)। তারা সেখানে রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। বিজনি রাজবংশের শাখা সিদলি ও অভয়পুরীতেও এখনো রাজবাড়ীগুলি সুন্দরভাবে রক্ষিত আছে। বিজনি রাজপরিবারের দ্বারা স্থাপিত ৩৩৭বছরের বুড়ি ঠাকুরানী থান / ভবানী দেবী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, বিজনী সত্র, ঠাকুরানী মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির ও অন্যান্য দেবালয়গুলি এখনও ঐতিহ্যের ছোঁয়া ও ধারাবাহিকতা রেখে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছে।রাজপরিবার এই দেবালয় গুলির নিত্যপুজা, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়মিত দেখাশোনা করার জন্য ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে দায়িত্ব অর্পণ করেন।ট্রাস্টি বোর্ড যথেষ্ট শ্রদ্ধা সহকারে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দীর্ঘদিন ধরে পালন করে চলে আসছেন।
আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক জায়গা দর্শন এবং তাদের নিদর্শনগুলি স্বচক্ষে দেখে খুবই অভিভূত এবং আনন্দিত হয়েছি।বিভিন্ন নিদর্শন, বিশেষ করে মন্দিরগুলি পুরনো কাঠামোকে অক্ষত রেখে যেভাবে সংস্কার করা হয়েছে বা হচ্ছে তা সত্যি অতুলনীয়।ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ধনঞ্জয় রায়,সম্পাদক, কোষাধক্ষ্য ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দের অতিথিয়তা ভোলার নয়। তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা, রাজপরিবারের বিভিন্ন বিষয়গুলি খুঁটিনাটি ভাবে দেখানো ও বর্ণনা খুবই ভালো লেগেছে। সুযোগ পেলে আমাদের পূর্বপুরুষের সম্পর্কের বাঁধন ছিল সেই বাঁধনকে শক্ত রাখতে আবার কোন একদিন আসব।