কুচবিহার – আসাম রাজকাহিনী। Coochbehar Assam Rajkahini or Royal Connection
ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস একদা কামরূপ, কামতা – কুচবিহার রাজ্যের অঞ্চল আসাম, একটি স্বতন্ত্র রাজ্য, আর কুচবিহার একটি প্রান্তিক জেলা। কুচবিহার আসাম রাজকাহিনী (Coochbehar Assam Rajkahini) বা কুচবিহারের সাথে আসামের রাজকীয় সংযোগ সুদূর অতীত কাল থেকে।
Writer: Kumar Mridul Narayan
একদা কুচবিহার – আসাম বলে কিছু ছিল না প্রাগজ্যোতিষপুর, কামরূপ, কামতা, কুচবিহার বিভিন্ন সময়ে এর নাম পরিবর্তন হয়েছিল। ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে কুচবিহার এর সঙ্গে বর্তমান আসাম রাজ্যের একটা প্রগাঢ় সম্পর্ক ছিল, আজ সম্পর্কটুকুও শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অটুট থাকলেও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ততটাই গুরুত্বহীন। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে কুচবিহার রাজ্যের প্রথম রাজধানী স্থাপন হয়েছিল কোকড়াঝাড় (Kokrajhar) জেলার চিকনা পবর্তে (Chikna mountain)। মহারাজ বিশ্ব সিংহ প্রতিষ্ঠিত কামতা – কুচবিহার রাজবংশের পরিধি উত্তর-পূর্ব ভারতের যে বিস্তীর্ণ এলাকাকে নিয়ে করেছিলেন তার সুযোগ্য উত্তরসূরি দুই পুত্র মহারাজা নরনারায়ণ এবং তার ভাই চিলারায় পিতার রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। এক কথায় উত্তর পূর্ব ভারত নিয়ন্ত্রণে ছিল কুচবিহার রাজ্যের। রাজ্যের ব্যাপ্তি বিশাল হওয়ায় মহারাজা নরনারায়ণ (Maharaja Naranarayan) সংকোশ নদীর পূর্ব প্রান্ত ছোট ভাই শুক্লধ্বজ নারায়ণকে “রাজা” উপাধি দিয়ে বিজনী, দরং, বেলতলা এবং কামাক্ষা ক্ষেত্রের উত্তর অংশের শাসনভার অর্পণ করেন। আরেক ভাই গোহাই কমল আলীকে (কমল নারায়ণ ) কাছাড়ের দায়িত্ব দেন এবং তিনি নিজে সংকোষ নদীর পশ্চিমপ্রান্ত শাসন করেন।
মহারাজ নরনারায়ণ চিলা রায়ের পুত্র রঘুদেব নারায়ণকে (Raghudev Narayan) খুব স্নেহ করতেন এবং তাকে কোলে নিয়ে সিংহাসনে উপবিষ্ট হতেন। এমনকি তিনি পাটকুমার বা যুবরাজ বলেও অভিহিত হইতেন এবং মহারাজের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় রঘুদেব নারায়ণ ছিলেন সিংহাসনের উত্তরসূরী। কিন্তু মহারাজ নরনারায়ণের পুত্র রাজকুমার লক্ষ্মীনারায়ণ জন্মগ্রহণ করলে সব হিসাব উল্টে যায়। রঘুদেবনারায়ণ চলে যান সংকোশ নদীর পূর্বপ্রান্তে এবং সেখানে “ছোট রাজা” উপাধি প্রাপ্ত হন। সেই সময় কামতা কামরূপ কুচবিহারের বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে শাসন করেছিল কুচবিহার রাজবংশের শাসকগণ। সাময়িকভাবে রাজবংশ এবং জ্ঞাতিদের মধ্যে সমন্বয় না থাকলেও আন্তরিকতার অভাব ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল। বর্তমান সময়ে কুচবিহার এবং আসাম রাজবংশের উত্তরসূরী প্রতিনিধিদের মধ্যে পারিবারিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় হয়।
আসাম আজ একটি পূর্ণ রাজ্যে পরিণত হলেও ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাসে কুচবিহার আজ একটি প্রান্তিক জেলা। কুচবিহার রাজবংশের বীরসন্তান বিশ্ববীর চিলারায়, পরবর্তীতে আসামের রাজা, তাকে নিয়ে শুধু আপামর জনগণ নয়, আসাম রাজ্য সরকার তাকে যথাযথ মর্যাদা এবং সম্মান দিয়েছে। তার কর্মকাণ্ডকে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তার গৌরব কাহিনী অন্তর্ভুক্ত করেছে।জেলায় জেলায় তার পূর্ণবয়ব মূর্তি এবং তারই নামাঙ্কিত পার্ক স্থাপন করেছি। শুধু তাই নয় মূর্তি এবং পার্ক তৈরীর ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। সাতটি জেলা ঘোরার পর আমার মনে হয়েছে আসাম এবং চিলারায় যেন সমার্থক।
Myself and child / Guwahati Amingaon
আজ আমাদের কুচবিহারে দাবি উঠেছে চিলা রায়ের গৌরব ইতিহাস সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। একদম ন্যায্য দাবি। কিন্তু চিলারায় যে রাজবংশের সেনাপতি ছিলেন সেই রাজবংশের ইতিহাস যদি তুলে ধরা না হয়, মহারাজাদের ইতিহাস এবং কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয় তাহলে কিন্তু ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
মহারাজা নরনারায়ণ এর রাজ্যভাগ, মহারাজা লক্ষীনারায়ন এর রঘুদেবনারায়ন, পরীক্ষিত নারায়ণের সম্পর্ক এই বিষয়গুলো পাঠ্যসূচিতে রাখা প্রয়োজন।
সম্প্রতি রাজ্যে সরকার কুচবিহার চকচকা চৌপথিতে বীর চিলারায় (Vir Chila Ray) এর মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এর কাজও শুরু হয়েছে। বীর চিলারায় এর মূর্তির মুখমণ্ডল বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে দেওয়া হয়েছে। এটাকে ঠিক ভুলও বলা যাবে না। বিভিন্ন পুঁথি, গৌহাটি মিউজিয়ামে রক্ষিত চিলা রায়ের প্রকৃত ছবি দেখে বোঝা যায় তার মুখমণ্ডল কখনোই ডিম্বাকৃতি ছিল না। আমি স্বচক্ষে আসামে প্রায় ২৫ খানা মূর্তি দেখেছি এবং এবং প্রত্যেকটা মূর্তির মুখমন্ডলের গঠন প্রাচীন একজন বীর যোদ্ধার যেমন রূপ হয়, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, তলোয়ার ধরার অভিব্যক্তি, শত্রুপক্ষকে ছোবল মারার দৃষ্টিভঙ্গি রন্ধে রন্ধে বিদ্যমান। আমাদের জেলাতেও আছে এরকম দুএকটি মূর্তি। সবথেকে আমার যে মূর্তিটা একদম প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে (সম্ভবত জেলা প্রশাসন বা রাজ্য সরকার এই মূর্তিটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ) সেটি হল “আমিনগাঁও” (Amingaon) চৌপথি, সরাইঘাট ব্রিজ এর পূর্ব প্রান্তে, কামরূপ জেলায় আসাম রাজ্যে সরকারের নির্মিত চিলারায় পার্ক এবং ৫০ ফুট উচ্চতা যুক্ত মূর্তি। মূর্তির আকৃতি, গঠন প্রকৃত একজন বীর যোদ্ধার প্রতিরূপ। স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমার সৌভাগ্য আমি এর দর্শন পেয়েছি।
আজ আসাম (Assam) এবং কুচবিহার (Coochbehar) এর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস আজ “আমার আমার” “তোমার তোমার” হয়েছে। সম্পৃক্ত এবং সংযুক্ত একটা ইতিহাস ছিল সেটাকে আড়াল করা হচ্ছে। আসাম কুচবিহারের রাজপরিবারের ইতিহাস আজ আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত একটা গৌরব ছিল, আজও বিদ্যমান।
বিজনি (Bijni Royal Family), দরং (Darang Royal Family), বেলতলা রাজবংশের (Beltola Royal Family) উত্তরসূরিদের সঙ্গে কুচবিহার রাজবংশের উত্তরসূরিদের নিবিড় যোগাযোগ এখনো আছে।
ইতিহাসের সন্ধানে এবং ভালোবাসার টানে একদা কুচবিহার রাজ্যের অঞ্চল ৩৫০ কিলোমিটার দূরে আসাম ঘোরার সাথে সাথে কালাপাহাড় দর্শন, চিলা রায়ের সুদর্শন মূর্তির দর্শন হয়ে গেল।
(বংশানুক্রমিক অভিশাপ থাকায় কামাখ্যা দর্শন আমরা করতে পারি না )।
আরো পড়ুন