Some age old temples of Coochbehar / কুচবিহারের প্রাচীন মন্দির
1. বড় মহাদেবের ধাম (দামেশ্বর শিবমন্দির ), বারোকোদালী ,তুফানগঞ্জ
2. সিদ্ধেশ্বরী মন্দির বা দ্বিতীয় কামাখ্যা পীঠ, বানেশ্বর
3. শ্রীশ্রী মাচন্ডী মন্দির(আয়রানী চিতলিয়া), মারুগঞ্জ
4. ষন্ডেশ্বর শিবমন্দির বা ছোট মহাদেব, নাককাটি গাছ, তুফানগঞ্জ
5. ভুচুংমারি আবাসতলী / ভুচুংমারির বলরাম মন্দির / বলরাম আবাস, নাটাবাড়ি
6. দরিয়া বলাই/ঈশ্বর বলরামের ধাম, তুফানগঞ্জ
7. মুক্তেশ্বর শিবমন্দির, সিঙ্গিজানি, মোয়ামারি
8. মদনমোহন মন্দির, ফলনাপুর ছিটমহল, সাঙ্গারবাড়ি
9. বড়বাড়ি শিব মন্দির / রায় বসুনিয়া পরিবারের বড়বাড়ির দ্বিতীয় জল্পেশ মন্দির
বড় মহাদেবের ধাম (দামেশ্বর শিব মন্দির)
কুচবিহার জেলার (Coochbehar district) সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের ধর্মীয় পীঠস্থান মন্দির বা দেবালয়গুলি সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় এবং বীরত্বের স্বাক্ষর বহন করে চলছে। এই ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলি কুচবিহার জেলা, উত্তর-পূর্ব ভারত তথা অন্যান্য প্রান্তের অন্যতম পুরাসম্পদ। প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে ইতিহাস বিজড়িত এই সম্পদগুলো আজও আমাদের মনে সদাজাগ্রত। কুচবিহার রাজবংশের কূলদেবতা শিব। কুচবিহারের মানুষের সংস্কৃতি ও লোকাচারের গুরুত্বপূর্ণ দেবতাও হলেন এই শিব।
Dameshwar Shiva Temple
তুফানগঞ্জ শহর (Tufanganj town) থেকে ১০কিমি দক্ষিণ পূর্বে বারোকোদালী গ্রামে ইতিহাস বিজড়িত অন্যতম প্রাচীন দামেশ্বর শিবমন্দির অবস্থিত। বর্তমানে মন্দিরটি দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের অধীনে আছে। দামেশ্বর শিবের ধর্মীয় মাহাত্ম্য ওই অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ আকর্ষণীয়। বারোকোদালীর এই দামেশ্বর শিব এই অঞ্চলে বড় মহাদেব নামে পরিচিত এবং পূজিত হন। জনশ্রুতি অনুসারে জানা যায়, মহারাজা নরনারায়নের ভ্রাতা শুক্লধ্বজ (চিলারায়) এই বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি মন্দির নির্মাণ করেন। যদিও প্রাচীন মন্দিরের কোন চিহ্ন বর্তমানে নেই। বর্তমানে যে মন্দিরটি রয়েছে সেটা খুব বেশি পুরনো নয়। পশ্চিমমুখী মূলমন্দিরের দেওয়াল এবং ভিত্তি বেদী, মেঝে পাকা হলেও চালা টিনের, একটি ছোট্ট বারান্দা আছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের পাশে দামেশ্বর শিবলিঙ্গের অবস্থান। এছাড়াও দক্ষিণা কালী, নবগৌরঙ্গ, নাড়ুগোপাল, শালগ্রাম শিলা মূর্তি ও আছে। বর্তমান পূজারী শচীন্দ্র দেব শর্মা বলেন, সকাল ১০টা (দশ) থেকে এখানে নিত্য পুজো শুরু হয় এবং দুপুর ১টার (একটা) মধ্যে পুজো সম্পন্ন হয়। নিত্য পূজা উপলক্ষে এলাকাবাসী এবং পুণ্যার্থীদের উপস্থিতিতে দামেশ্বর শিব মন্দির (Dameshwar Shiva Mandir) প্রাঙ্গন উৎসব মুখর হয়ে ওঠে । শচীন্দ্রদেব শর্মা বলেন, প্রথা অনুসারে তারা বংশপরম্পরায় এখানে পূজা করে আসছেন । তার পূর্বপুরুষ রতিকান্ত দেবশর্মা, কমলাকান্ত দেবশর্মা, চন্দ্রকান্ত দেবশর্মা, নিশিকান্ত দেবশর্মা আগে পুজো করতেন। বর্তমানে এখানে দেউড়ি হিসেবে নিযুক্ত আছেন বিমল চন্দ্র বর্মন এবং কেয়ারটেকার হিসেবে নিযুক্ত আছেন করেন বর্মন। পূজারী শচীন্দ্র দেব শর্মা আরো বলেন দেবত্র ট্রাস্ট অধীন এই মন্দিরের পূর্বে ১১ বিঘা জমি ছিল এবং বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ বা সোয়া ২ বিঘা। এছাড়াও রয়েছে পুণ্যার্থীদের বিশ্রামঘর ও ভান্ডার ঘর। মূল মন্দিরের উত্তর রয়েছে সুরক্ষা বিহীন ভাবে দাঁড়ানো একটি ত্রিশূল, এর ঠিক পূর্ব পাশেই রয়েছে কিছু প্রাচীন পাথর। প্রাচীন কাঁঠাল ( সারাবছর ধরে ফল হয় ) গাছ ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণে, রয়েছে প্রাচীন কুয়ো। এককথায় প্রাচীনত্বের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায় মন্দির প্রাঙ্গণে। এলাকাবাসী সমির রায় জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে মন্দির প্রাঙ্গণ এলাকাটি বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখার দাবি রাখছেন । তিনি আরো দাবি করেন, প্রাচীন এই মন্দিরটি সর্বক্ষণের রক্ষণাবেক্ষণ ও নজরদারির প্রয়োজন। আরেকজন এলাকাবাসী বললেন, নামমাত্র সংস্কার হয়েছে এই মন্দিরটির।
প্রাচীন এই ঐতিহাসিক মন্দির পদার্পণের মধ্য দিয়ে আমরা (তারিখ: ২৪/১০/২০২১) – ( কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ, কুমার মৃদুল নারায়ন, কুমার দেবাংশ নারায়ন )
স্বচক্ষে অনুভব করতে পারলাম ইতিহাসকে। অভিজ্ঞতা বলে এই দেবস্থানটি যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি এখানকার জনসাধারণের মধ্যে লুপ্তপ্রায় ইতিহাস, গৌরব, কৃষ্টি, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি ভক্তপ্রাণ মানুষের মনে আজও চিরস্থায়ী। কুচবিহার মহারাজাদের এই অক্ষয় কীর্তি বিস্ময়করই নয়, চিরস্মরণীয় , আকর্ষণীয়।
দেবত্র ট্রাস্ট, জেলা প্রশাসন ও রাজ্য সরকার প্রাচীন মন্দিরের দিকে নজর দিক, মন্দিরের জায়গাটিকে নির্দিষ্ট করে বাউন্ডারি ওয়াল দিক,প্রয়োজনীয় সংস্কার করুক এবং সর্বোপরি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলুক।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দির বা দ্বিতীয় কামাখ্যা পীঠ
কুচবিহারের রাজগন বা রাজজ্ঞাতিদের মা কামাখ্যার দর্শন
মন্দির দর্শন ২৪/১০/২০২১ তারিখ
কুচবিহার জেলার শক্তিপীঠ গুলির মধ্যে সিদ্ধেশ্বরী অন্যতম শক্তিপীঠ। দেবী সিদ্ধেশ্বরীর (Devi Siddheshwari) নামেই মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের নাম সিদ্ধেশ্বরী। টেরাকোটা কারুকার্য বিশিষ্ট মন্দিরের কারুকার্য বা শৈলী কুচবিহারে বিরল। আটকোনাযুক্ত দেওয়ালের উপর গম্বুজ শোভিত মন্দির কুচবিহার জেলায় অন্যত্র কোথাও দেখাই যায় না। পশ্চিমবঙ্গের দু’একটি জেলায় এরকম কারুকার্য যুক্ত মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায়। বীরভূমের কিছু মন্দিরের কারুকার্যে এরকম নিদর্শন লক্ষণীয়। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৩২ ফুট। পুরনো আমলের সরু ইট দিয়ে তৈরি এবং আটকানোযুক্ত মন্দিরের উপরে রয়েছে একটি গম্বুজ। গম্বুজের উপর আমকলস ও ত্রিশূল লাগানো আছে। মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে প্রায় ৬ফিট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। গর্ভগৃহের মেঝেতে মার্বেল পাথর লাগানো আছে। গর্ভগৃহে সিংহাসনের উপর অষ্টধাতু নির্মিত সিদ্ধেশ্বরী দেবীমূর্তি উপবিষ্টা আছেন। দেবীর উপরের দুই হাতের আঙ্গুলে মুদ্রা (কর্তরী ও খড়গ)এবং নিচের দুই হাতে দর্পণ ও অভয় মুদ্রা। দেবীর ভৈরব হল সিদ্ধেশ্বর। সিদ্ধেশ্বর গর্ভগৃহের মেঝেতে অবস্থিত খোদিত এক শিবলিঙ্গ বিশেষ। দেবীর নিত্য পূজা হয়। বিশেষ তিথি যেমন দুর্গাপূজা, কালীপূজা, অমাবস্যার এবং সংক্রান্তি ছাড়াও অম্বুবাচীতে বিশেষ পূজার আয়োজন হয়ে থাকে। পূর্বে দুর্গাপূজা উপলক্ষে পাঠা বলি হতো,বর্তমানে পায়রা বলি হয়। মানত হিসেবে ভক্তবৃন্দ হাঁস, পায়রা, ছাগল বলি দেয়।
মন্দিরের পশ্চিম প্রান্তে প্রাচীরবেষ্টিত একটি প্রাচীন কামরাঙা গাছ আছে। গাছটির গোড়া সুতো দিয়ে বাঁধানো এবং গোড়াতে সিঁদুর লিপ্ত কয়েকটি শিলাখণ্ড আছে। এই কামরাঙা গাছটি দেবী কামাখ্যার প্রতীক এবং পীঠস্থান রূপে পূজিত হয়। দেবী কামাখ্যা দর্শনের অভিশাপ থাকায় তৎকালীন কুচবিহার রাজ্যের মহারাজগণ,রাজগণ বর্তমান জেলার রাজজ্ঞাতী বা রাজগণ এই কামরাঙা গাছেই দেবী কামাখ্যাকে দর্শন করেন এবং পূজা দেন।
Siddheswari Shiva Temple, Baneshwar
কুচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নরনারায়ন ধ্বংসপ্রাপ্ত কামাখ্যা মন্দির তার ভাই শুক্লধ্বজ (চিলারায়) এর সাহায্যে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেছিলেন । মহারাজা নরনারায়ণ এবং তার ভাই চিলারায় মা কামাখ্যার বিশেষ ভক্ত ছিলেন । মহারাজা কামাখ্যা দেবীর সেবাপূজা করার জন্য মৈথিল ব্রাহ্মণ আনয়ন করেছিলেন এবং তাদেরকে ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন । মন্দিরের ব্যয় নির্মাণের জন্য দেবোত্তর ভূমি,সেবকগণ এর ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত জমি ও দান করেছিলেন। কামাখ্যা দেবীর অম্বুবাচী এবং দুর্গাপূজা উপলক্ষে কুচবিহার থেকে নিয়মিত নির্মাল্য পাঠানো হতো। জনশ্রুতি আছে, সন্ধ্যা আরতির সময় ঘণ্টার তালে তালে দেবী কামাক্ষা নগ্নমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে নৃত্য করেন। একদিন মহারাজ নরনারায়ন কেন্দুকলাই নামক পূজারীর সাহায্যে আড়াল থেকে নৃত্যরতা দেবীকে দর্শন করেন।মা কামাখ্যা এই বিষয়ে অবগত হয়ে অভিশাপ দেন-
“অতঃপর বেহাররাজগণের কামাখ্যা এবং নগ্ন দেবমূর্তি দর্শন নিষিদ্ধ”
অর্থাৎ কুচবিহার রাজবংশের সকলকে কামাক্ষা দেবীর মন্দির দর্শন নিষিদ্ধ করে দেন। পূজারী ব্রাহ্মণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।
একই কারণে কুচবিহার রাজগনদের গোসানিমারির (কামতাপুর) কামতেশ্বরী দর্শন ও নিষিদ্ধ হবার জনশ্রুতি আছে।
অভিশাপ প্রাপ্ত হয়ে মহারাজা নরনারায়ণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করে বলেন যে, তার অপরাধে তার বংশধরেরা মায়ের মূর্তি দর্শন ও পূজা দেওয়া থেকে কেন বঞ্চিত হবে। এতে মা কামাখ্যা সদয় হয়ে বলেন, তিনি বানেশ্বর শিব মন্দির এর কাছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দেবী বিগ্রহে এবং পাশে প্রাচীন কামরাঙা বৃক্ষে দেবীরূপে সর্বদা বিরাজ করবেন। মহারাজগন এবং রাজগণ সেখানে পূজা দিলে মা কামাখ্যার দর্শন ও পূজা দেওয়া হবে।
মহারাজা নরনারায়ণের অভিশাপপ্রাপ্তির পর থেকে কোন মহারাজা বা রাজগণ আজ পর্যন্ত গৌহাটি অবস্থিত মা কামাখ্যা দেবীকে দর্শন করেননি।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের প্রকৃত নির্মাতাকে এ বিষয়ে এখনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে মন্দিরের প্রবেশ পথের দরজার উপর লেখা আছে ১২৮৪ সালে প্রথম মন্দির সংস্কার (মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন এর রাজত্বকালে )। উত্তরমুখী এই মন্দিরের সামনে একটি পাকা চত্বর আছে।এই পাকা চত্বর এবং তৎসংলগ্ন মন্দির এলাকা নিয়মিত সংস্কার না হওয়ার ফলে প্রাচীন এই মন্দিরের অবস্থা খুবই করুন । মন্দিরের সামনে একটি পুকুর আছে, এটারও সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন। দেবত্র ট্রাস্ট পরিচালিত এই মন্দিরে বর্তমান জায়গার পরিমাণ ৩বিঘা কয়েক ধুর (বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরানো ) এবং এর বাইরে কিছু জমি এখনো আছে।
অসমের নলবাড়ি নিবাসী কামরুপী ব্রাহ্মণরা (Kamrupi Brahmin) এখানে বংশপরম্পরায় পূজা করে আসছেন। বর্তমান পুরোহিত ধীরেশ্বর দেবশর্মা বলেন, স্বপ্ন প্রদত্ত মন্ত্র দিয়ে দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে আরাধনা করা হয়। নিত্য পূজা হয় নিয়মিত সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষ পূজাদি হয়ে থাকে।মূল মন্দির ছাড়াও এখানে একটি ভোগ ঘর, যাত্রী ঘর, পুলিশ ঘর আছে। কিছু প্রাচীন গাছ এখনো মন্দির চত্বরে দেখা যায়। দেউড়ি হিসেবে বর্তমানে দায়িত্বে আছেন গোপাল বর্মন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে এলাকাবাসীর মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা দেখা দেয় এবং ভক্তসমাগম হয় প্রচুর।
সরকার এবং জনগণের আন্তরিক প্রয়াসে আরও মহিমময় হয়ে উঠুক এই দেবস্থান বা পীঠস্থান। “দ্বিতীয় কামাখ্যাপীঠ” এর নাম সার্থক হোক।
গন্তব্য:- কুচবিহার শহর থেকে ১৩কিলোমিটার উত্তরে বানেশ্বর শিব মন্দির (Baneshwar Shiva temple) এর পাশ দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে এই মন্দির। মন্দিরের একদম উত্তর পাশে সিদ্ধেশ্বরী কোকিলাদেবী হাই স্কুল এর অবস্থান।
শ্রীশ্রী মাচন্ডী মন্দির (আয়রানী চিতলিয়া)
মন্দির দর্শন ২৫/১০/২০২১ তারিখ
কোন একটি অঞ্চলের স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অন্তপ্রকৃতি জানার ক্ষেত্রে দেবদেউল বা পুরাকীর্তির নিদর্শনগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় বিশ্বাস, পূজা-পার্বণ, মেলা, উৎসব আচার-আচরণ ও লোকগাথার মাধ্যমেও উক্ত অঞ্চলের ইতিহাস ও জানা সম্ভব। এরকমই তুফানগঞ্জ মহকুমার মারুগঞ্জ অঞ্চলের শতাধিক বছর প্রাচীন আয়রনী চিতলিয়া গ্রামে “মাচন্ডী ঠাকুর” (Maa Chandi Thakur) কুচবিহারের প্রাচীন ঐতিহ্য আজও বহন করে চলছে। মহারাজ হরেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে নাজির খগেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত (Source:- Harendra Narayan Chaudhary) মন্দিরের অস্তিত্ব না থাকলেও বর্তমান মন্দিরটি পুরনো মন্দির প্রাঙ্গণেই পুনপ্রতিষ্ঠিত। পূর্বে এই গ্রামের নাম ছিল চিতলিয়া দলবাড়ী। চিতলিয়া আসলে একটি বিল (lake)। বর্তমানে গ্রামটি আয়রাণী বা অরুনি নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের লোকজন এই গ্রামটিকে আয়রাণী চিতলিয়া বলে থাকেন বা এই অঞ্চলটি এই নামে পরিচিত। আনুমানিক ৫০ বিঘা বিশালাকায় এই চিতলিয়া বিলের ঠিক পূর্ব প্রান্তে চন্ডীঠাকুরের মন্দিরের অবস্থান। পূর্বে এই চিতলিয়া বিলটি দেবত্র ট্রাস্টের অধীনে ছিল। বর্তমানে এটি মৎস্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। যদিও মন্দিরটি এখনো কুচবিহার দেবত্র ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে আছে। মন্দিরের নিত্য পূজা, পুরোহিত, দেউড়িদের বেতন দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ড বোর্ড এর মাধ্যমে দেওয়া হয়।
Airani Chitlia, Maruganj
পশ্চিম-মুখী এই চন্ডীঠাকুরের মন্দিরটির ভিত ও ওয়াল পাকা এবং চাল টিন দিয়ে তৈরি। মন্দিরের ভেতরে একটি কাঠের সিংহাসন স্থাপিত। এই সিংহাসন এর উপর ৮ইঞ্চি (২০সে.মি ) উচ্চতা বিশিষ্ট দ্বিভূজা ও পদ্মাসনে উপবিষ্টা অষ্টধাতুর চন্ডীদেবীর মূর্তি। দেবীর দুদিকে জয়া ও বিজয়ার মূর্তি উপবিষ্টা রয়েছে। বর্তমান কামরুপী পুরোহিত বিপুল দেবশর্মা (আমাদের বংশানুক্রমিক পুরোহিত কামাখ্যা দেবশর্মার জ্ঞাতি ) জানান, রাজ আমলের বিশুদ্ধ পঞ্জিকা পাঠ করে এখানে নিত্য পূজা করা হয়। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ কিছু তিথি অমাবস্যা,দোল পূর্ণিমা, মকর সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তিতে পূজা হয়। বাৎসরিক পূজা হিসেবে মাশান ঠাকুরের পূজা হয়। সাটি মাছ, ঢোঙ্গলে দই চিড়া দিয়েও পূজা হয়। বর্তমানে মন্দির প্রাঙ্গণে এলাকাবাসী বারুনী স্নান উপলক্ষে ছোটখাটো মেলা ও উৎসবের আয়োজন করেন । লোকোশ্রুতি অনুসারে প্রাচীন এই চন্ডীদেবীর আরাধনায় অনেকে সুফল পেয়েছেন। এলাকাবাসীর মধ্যে চন্ডী ঠাকুরের প্রভাব যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায় বা অটুট আছে। দেবতুল্য এই দেবীকে তারা ভক্তিচিত্তে দর্শন করেন। পরিবারের মঙ্গল কামনার্থে অনেকেই দেবীকে “পায়রা” উৎসর্গ করেন। তারা বিশ্বাস করেন চন্ডি মায়ের কাছে মানত করলে সুফল তারা অবশ্যই পাবেন।
সত্তরের দশকে এলাকাবাসী চিতলিয়া বিলের ঘাটে গঙ্গা পূজা ও গঙ্গাস্নানের ব্যবস্থা করেন। তারা বিশ্বাস করতেন তাদের এই স্নান গঙ্গাস্নানের মতই পবিত্র। বর্তমানে এখানে বারুণী স্নান প্রচলিত।
মন্দির পরিচালনার জন্য পুরোহিত থাকলেও বর্তমান দেউড়ি বিদ্যুৎ ঝা তিনমাসের জন্য অস্থায়ীভাবে এখানে এসেছেন। সর্বক্ষণের জন্য একজন কেয়ারটেকার ও মন্দির চত্তর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য একজন ঝাড়ুদার থাকার কথা। প্রয়োজনীয় কর্মচারী না থাকার জন্য চরম অচলাবস্থা শুরু হয়েছে এই রাজ আমলের মন্দিরটিতে।নিত্য পূজার অর্থ দেবত্র ট্রাস্ট থেকে বরাদ্দ হলেও, অর্থসঙ্কটের মাঝে মাঝে ভক্তবৃন্দের প্রণামির টাকায় চন্ডীদেবীর অন্নের যোগান হয় ।
ইতিপূর্বে প্রায় ২০ বিঘা এলাকাজুড়ে মন্দিরের জায়গা থাকলেও বর্তমানে বেদখল হতে হতে জায়গার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০থেকে ১১ বিঘা। মন্দিরের প্রাঙ্গণে রয়েছে প্রাচীন আম, হরতকি, শালগাছ, রয়েছে বাঁশের বাগান। রয়েছে প্রাচীন অব্যবহৃত কুয়ো। অবিলম্বে মন্দিরের এলাকাটুকু পাকা ওয়াল দিয়ে না ঘিরে ফেললে অবশিষ্ট জমিটুকু থাকবে কিনা সন্দেহ জাগে। সেইসঙ্গে সব থেকে যেটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ মন্দির এবং মন্দির প্রাঙ্গনের যে জরাজীর্ণ এবং অচলাবস্থা সে গুলোকে দূর করতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার, মন্দিরের সংস্কার, রান্নাঘর, বিশ্রামাগার সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। না, হলে চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যাবে ইতিহাস বিজড়িত এই ঐতিহ্যবাহী মন্দির। পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষনীয় করে তুলতে পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে,নয়তো প্রাচীন এই মন্দির লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাবে এবং হয়তো বা কোনো একদিন ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে। সরকারিভাবে দেবত্র ট্রাস্ট এর দায়িত্ব থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ, পরিচর্যার আন্তরিকতার অভাব প্রকট ।
কুচবিহার থেকে গন্তব্য:-
কুচবিহার শহর থেকে মারুগঞ্জ হয়ে ১৩কিলোমিটার উত্তর পূর্ব প্রান্তে এই মন্দিরের অবস্থান। মারুগঞ্জ চৌপতি থেকে সোজা উত্তরে ৫কিলোমিটার গেলেই এই মন্দির পাওয়া যায়। আবার কুচবিহার থেকে রাজেন তেপথী হয়ে কালজানি বাজার অতিক্রম করে আলু ধোয়া (Alu dhoya bazar) বাজারের সন্নিকটে আয়রানী চিতলিয়া গ্রাম (Airani Chitlia village) এবং ওখানেই মন্দির।
তুফানগঞ্জ থেকে গন্তব্য :-
তুফানগঞ্জ (Tufanganj) এর থানামোড় চৌপতি থেকে সোজা কুচবিহার ৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে চিলাখানা (Chilakhana bazar) বাজার পার করে মারুগঞ্জ চৌপতি অতিক্রম করে সোজা উত্তরে আয়রনী চিতলিয়া গ্রামে চন্ডীদেবীর মন্দির।
ষন্ডেশ্বর শিবমন্দির বা ছোট মহাদেব
নাককাটি গাছ, তুফানগঞ্জ
কুচবিহার রাজ পরিবারের ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক মন্দিরগুলি আজও শতাধিক প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসকে অক্ষুন্ন রেখে ভক্ত প্রাণ মানুষের মনে চিরস্থায়ী বিরাজমান। তুফানগঞ্জ মহকুমা শহর থেকে ৩১নং কুচবিহার-আসাম জাতীয় সড়ক ধরে ৮কিমি দক্ষিণ পশ্চিম দিকে নাককাটি গাছ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কুচবিহার জেলার অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এই ষন্ডেশ্বর শিব মন্দির (Shondeshwar Shiva temple) বা ছোট মহাদেবের ধাম (Choto Mahadev Dham)। কুচবিহারের প্রথম ইতিহাস রচয়িতা মুন্সি জয়নাথ ঘোষ তার “রাজোপাখ্যান” গ্রন্থে এখানকার শিবকে “ষন্ডেশ্বর শিব” রূপে বর্ণনা করেছেন। কুচবিহার রাজবংশের উপাস্য দেবতাও শিব। নাককাটি গাছের ষন্ডেশ্বর শিব আজও কুচবিহার রাজবংশের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী জানা যায়, কুচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নরনারায়ণের ভ্রাতা শুক্লধ্বজ বা চিলারায় (Bir Chilaray) এই ছোট শিবের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি শিব মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। রাজোপাখ্যান গ্রন্থ থেকে জানা যায়,মহারাজ প্রাণ নারায়ন (১৬৩২-১৬৬৫) এই মন্দির সংস্কার করেছিলেন। নাজির দেও খগেন্দ্রনারায়ন ও এই মন্দির সংস্কার করেছিলেন। প্রাচীন এই মন্দিরটি বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে। ১৩০৪বঙ্গাব্দ, ১৮৯৭ইং এর ভূমিকম্পে মূল মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। নতুন করে নির্মাণ করা বর্তমান পশ্চিমমুখী চারচালা টিনের পাকা দেওয়াল বিশিষ্ট মন্দিরটির পিছনে প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে।এই ধ্বংসস্তূপের ভগ্নাংশগুলি প্রাচীনত্ব স্মৃতি বহন করে চলেছে, অনেক কৌতুহলী পর্যটক, ইতিহাসবিদ, গবেষক আজও ছুটে আসেন ধ্বংসস্তূপ দেখতে। বর্তমানে ছোট মহাদেবের শিব মন্দিরটি ছয় বিঘা জমির উপর অবস্থিত।
Shondeshwar Shiva Mandir, Nakkatigach
বর্তমানে ষন্ডেশ্বর বা ছোট মহাদেবের নিত্য পূজা হয়। পশ্চিমমুখী মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে কাঠের সিংহাসনের উপর অষ্টধাতুর তিনটি শিবলিঙ্গ , ভৈরব মূর্তি ও নারায়ন শাল গ্রাম শিলা আছে। একটি অদ্ভুত ধরনের শঙ্খ ও আছে। নিত্যপূজা ছাড়াও এখানে অম্বুবাচী দোল সওয়ারী এবং শিবরাত্রিতে বিশেষ পূজা হয়। দুর্গাপূজা উপলক্ষে এখানে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে দুই দিনের মেলা বসে। পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। দেবত্র ট্রাস্ট পরিচালিত ষন্ডেশ্বর শিব মন্দিরের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে দিঘি আছে। ১৯০৩ সালে একটি ইদারা স্থাপিত করা হয়, সংস্কারের অভাবে আজ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে উঠেছে। মন্দির প্রাঙ্গনের উত্তর পাশে আছে ভোগঘর এবং টিনের যাত্রী ঘর । মূল মন্দিরের গাঘেঁষে খোলা জায়গায় উত্তর পাশে আছে বারোঘারিয়া মাসান। ভক্তগণ আটিয়া কলা, চিড়া ,গুড় দিয়ে পূজা দেন। বহু পুরনো বেল, তমাল, নারকেল , তাল গাছ আছে মন্দির প্রাঙ্গণে ।
নাককাটি গাছের এই ষন্ডেশ্বর শিব মন্দির কুচবিহার রাজবংশের তৈরি শুধু একটি প্রাচীন মন্দির নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগ। রাজবংশের কুলদেবতা শিব আজ সকল মানুষের অন্তরে ধর্মীয় বিশ্বাসের বাতাবরণ এবং প্রভাব ফেলেছে। বাৎসরিক অনুদান ছাড়া দেবত্র ট্রাস্ট মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের দিকে নজর দেয় না।সর্বক্ষণের নজরদারি না থাকার ফলে হয়তো একদিন এই ধ্বংসাবশেষের অনেকটা অংশই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এই বিষয়ে প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ।
গন্তব্য :-
তুফানগঞ্জ শহর থেকে থানামোড় চৌপতি হয়ে ৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে চামটা মোড় থেকে ৭ কিমি সোজা দক্ষিনে দ্বীপেরপার নাককাটি গাছ গ্রামে এই মন্দিরটি অবস্থিত।
বি.দ্র.-২৪/১০/২০২১ তারিখে আমরা মন্দির দর্শন এ গিয়েছিলাম। কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ান, কুমার দেবাংশ নারায়ন সহযাত্রী। মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা হয়েছিল আসাম খ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী প্রবীর সরকার, বিশিষ্ট শিক্ষক দুলাল রায় এবং বিধান মণ্ডল এর সঙ্গে।
ভুচুংমারি আবাসতলী / ভুচুংমারির বলরাম মন্দির / বলরাম আবাস
মন্দির দর্শন, ১১/১২/২০২১
কুচবিহার শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে ও নাটাবাড়ি বাজার থেকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের অধীনে ভুচূংমারি গ্রামে পশ্চিমমুখী এই দেবালয়টি অবস্থিত। তুফানগঞ্জ মহকুমার মানুষের কাছে এটি “বলরাম আবাস” নামেও পরিচিত। দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ড এর অর্থ সাহায্য এই মন্দিরের পূজার খরচাদি ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় ।জনশ্রুতি থেকে জানা যায়,মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। একদিন মহারাজা খেয়াযোগে কালজানি নদী পার হয়ে ডাঙ্গায় উঠার সময় মন্দির সম্মুখে বাধাপ্রাপ্ত হন এবং অনেক কষ্টে চরাভূমিতে উঠেন। চরাভূমিতে উঠে বিশ্রামকালে তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন। স্বপ্নে “বলরামঠাকুর” তাকে জানান, নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত বৃক্ষতলই তার আবাসস্থল, বৃক্ষপাশে বলরাম ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠা করে ভক্তিভরে পূজা দিলেই তার যাত্রাপথ সুগম হবে এবং সমস্ত বাধাবিঘ্ন দূর করে তার সকল মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে।কিংকর্তব্যবিমূঢ় মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ন ভক্তি সহকারে পূজা-অর্চনার মাধ্যমে বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। সেই থেকে এলাকাটি ভুচুংমারী আবাসতলী এবং মন্দিরটি বলরাম আবাস নামে পরিচিত। লোকমুখে শোনা যায়, বলরাম ঠাকুরের আবাস এবং বৃক্ষের তল মিলে একযোগে নামকরণ হয়েছে “আবাসতল”। ইতিহাস সাক্ষী শতাব্দীপ্রাচীন এই মন্দিরের পশ্চিম পাশে এখনো গদাধর নদী প্রবাহমান। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই গদাধর নদীর উপর নতুন সেতু নির্মাণ করেছেন এবং যোগাযোগের এক নতুন দিশা দেখিয়েছেন।
Balaram Dham Bhuchungmari
তুফানগঞ্জ মহকুমায় দেবত্র বিভাগের যতগুলি দেবালয় আছে তারমধ্যে পরিবেশগতভাবে সবচেয়ে মনোরম এই বলরাম আবাস। মন্দির চত্বরে রয়েছে অনেক প্রাচীন প্রাচীন গাছ, পিছনে রয়েছে একটি সুন্দর ফুলের বাগান, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালজানি নদী। এককথায় নৈসর্গিক অনুভূতি পাওয়া যায় মন্দির প্রাঙ্গণে।
মূল মন্দির, ভোগ ঘর, বিশ্রামাগার এবং প্রাঙ্গণসহ মোট জমির পরিমাণ ৭(সাত) বিঘা। চারচালা টিনের মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে অষ্টধাতুর বলরামের দুটি বিগ্রহ এছাড়াও রয়েছে গণেশ, নাড়ুগোপাল ও কৃষ্ণমূর্তি। বলরামের মাথায় রয়েছে মোহনচূড়া ও দুহাতে সোনার গাছা। নিত্য পূজা ছাড়াও এখানে বিশেষ বিশেষ তিথিতে রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা বিশেষ অনুষ্ঠান ও মেলা হয়। দোলসোয়াড়ী উপলক্ষে বাৎসরিক মেলা হয়। মূল মন্দিরের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে অনেকগুলি ঘন্টা ঝুলানো আছে । এখানকার পুজোর বৈশিষ্ট্য হল, এখানে বলি হয় না এবং নিরামিষ প্রসাদে তেল এবং ঘি ব্যবহার করা হয় না। এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কামাখ্যা দেবশর্মা (আমাদের পারিবারিক পুরোহিত) বংশানুক্রমিকভাবেই এখানে পুজো করে চলে আসছেন ।
তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরাম মন্দিরটি আজ ভক্তপ্রাণ মানুষের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। বড় অষ্টমী স্নান উপলক্ষে প্রচুর লোক সমাগম হয় এখানে। পূর্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা আশানুরূপ না থাকলেও বর্তমানে কালজানি নদীর উপর সেতু নির্মাণ হওয়ার ফলে কুচবিহার শহর,নিউ কুচবিহার রেল স্টেশন, নিউ বানেশ্বর রেল স্টেশন থেকে হেরিটেজ রোড ধরে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় এই মন্দির। পরিবহন ব্যবস্থা আরও জোরদার হলে ঐতিহ্যবাহী মন্দির দর্শন করতে পারবে পর্যটক ও তীর্থযাত্রীরা। এত সুন্দর মনোরম পরিবেশ সমৃদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গন অবশ্যই ভালো লাগবে সকলের।
পরিশেষে এই মন্দিরের সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের জন্য নজরদারি প্রয়োজন। মন্দিরের জমি কংক্রিটের ওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা খুবই জরুরি, কিছু জমি বেহাত হয়ে গেছে এরকম ও শোনা যায়। দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড এবং জেলা প্রশাসন সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করুক এ বিষয়ে।
দরিয়া বলাই / ঈশ্বর বলরামের ধাম, তুফানগঞ্জ
“বিখ্যাত ছোট অষ্টমী স্নান” (দেবালয় দর্শন ২৮/১২/২০২১)
তুফানগঞ্জ মহকুমার চিলাখানা মৌজায় ঘোগারকুটি (Ghogarkuti) গ্রামে গদাধর নদীর (River Gadadhar) পাশেই অবস্থিত এই দেবালয়। আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দেবালয়টি নির্মিত হয়। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিক প্রমাণসাপেক্ষ, তথ্য এবং গ্রন্থের বর্ণনা থেকে জানা যায় মহারাজ উপেন্দ্র নারায়ণের (১৭১৪-১৭৬৩খ্রিষ্টাব্দ ) রাজত্বকালে নাজির দেও শান্ত নারায়ণ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং পুজো অর্চনার ব্যবস্থাও করেছিলেন। একসময় এই মন্দির দেবত্তর এর অধীনে থাকলেও বর্তমানে স্হানীয় লোকজন কমিটি করে মন্দিরটি পরিচালনা করেন। দরিয়া কথার অর্থ নদী এবং বলাই অর্থে বলরাম। এক কথায় নদীর তীরে বলরাম। বলরাম ঠাকুরের নামানুসারে ওই এলাকার নাম দরিয়া বলাই (Daria Balai) বা বলরামের ধাম।
Balaram Dham, Dariabalai, Tufanganj
বলরাম ঠাকুরের দেহত্যাগের কাহিনী
লোকশ্রুতি অনুযায়ী এবং মন্দির প্রাঙ্গনের সামনের অঙ্কিত চিত্রের বর্ণনা অনুযায়ী, আজ থেকে অনেক অনেক বছর পূর্বে বাবা বলরাম লাঙ্গল দিয়ে জমিতে চাষ করেছিলেন। দীর্ঘক্ষন রোদে মাঠে চাষ করার ফলে তার প্রচন্ড জল তেষ্টা পায়। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তিনি তার স্ত্রীকে হাতের প্যান্টির ইশারায় জল নিয়ে আনতে বলেন। হতভম্ব স্ত্রী ভেবেছিলো তার দিকে বলরাম প্যান্টি তাক করে মারতে আসছেন। ভয়গ্রস্থ হয়ে বলরামের স্ত্রী মুখ ঘুরে দৌড়াতে লাগলেন। স্ত্রীর দৌড়ানো দেখে বলরাম তার পিছু নেন। দৌড়ানোর সময় বলরামের স্ত্রীর হাত থেকে কলস পড়ে যায় ভুচুংমারি (বলরাম আবাস এর নিকটে) এলাকায় ও তৃষ্ণার্ত বলরাম পড়ে যান দরিয়া বালাই এলাকায় এবং সেখানেই বাবা বলরাম দেহত্যাগ করেন। বলরামের হাতের প্যান্টি গিয়ে পড়ে বর্তমান ধুবুরী জেলার ন্যাতা পোতা ঘাটে (এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা অনুযায়ী)। সেই থেকেই ন্যাতা পোতাঘাটে অষ্টমী তিথিতে দরিয়া বালাই এর অনুকরণে অষ্টমীর স্নান ও মেলা হয়ে আসছে।
*কৃষির দেবতা অসীম বলিয়ান বলরাম ঠাকুর মন্দির গৃহে পূর্ব-পশ্চিমে শায়িত আছেন পাকা দেওয়াল এবং চারচালা পশ্চিমমুখী মন্দিরে। আনুমানিক ১৫ হাত বা তাঁর বেশী দীর্ঘদেহী লম্বা পাথরের মূর্তি, পূর্বে মাটির মূর্তি ছিল। হাতে রয়েছে একটি লাঙ্গল ও জোয়াল। পূর্বে নিত্য পূজা হত এই দেবতার কিন্তু বর্তমানে আর্থিক দুরবস্থার জন্য বিশেষ তিথিতে শুধুমাত্র পূজা হয়। এছাড়া কোনো পুণ্যার্থীর বিশেষ মানাতে এখানে পুজো হয়। দোলসোয়ারি, অষ্ঠপ্রহর, জন্মষ্টমী, রাধাষ্টমীতে এখানে পূজা হয় স্থানীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে। এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে এবং কৃষক সমাজের কাছে এই দেবতা শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়।
বলরাম ঠাকুরের বিশেষ আকর্ষণ হল চৈত্র মাসে অষ্টমী তিথি উপলক্ষে এখানে হাজার হাজার পুণ্যার্থী স্নান করে এবং বাবা বলরামের দর্শনে পূর্ণতা লাভ করে। প্রচলিত ছোট অষ্টমীর স্নান বা গদাধরের মেলা উপলক্ষে এখানে বিরাট মেলা বসে। ভোর থেকেই স্নান শুরু হয়। স্নানাদির পরে বাতাসা, ফুল, জল দিয়ে মন্দিরে পুজো করে ভক্তরা। তারপরে কাদা মাটির ঢেলা করে তুলসী গাছ পুঁতে দেওয়া হয় এবং ফুল, জল দিয়ে বাবা বলরামের উদ্দেশ্যে পুজো দেয়। পূজার পর দই চিড়া খাওয়া হয়। তীর্থযাত্রী দই চিড়া নিয়ে আসে। পাঠা, কবুতর প্রভৃতি উৎসর্গ করেন অনেক তীর্থযাত্রী। তিনদিন ব্যাপী এই মেলা চলে। গদাধরের জলে ডুব দিয়ে সখা ও সখি পাতানোর ব্যবস্থা আছে। একই বয়সের ছেলে বা মেয়ে ও বয়স্ক ব্যক্তি যৌথভাবে গুয়া পান হাতে নিয়ে ডুব দিয়ে উঠলে ওরা দুজনে সখা ও সখীতে পরিণত হয়। তুলসী তলায় গুয়া ও পান হাতে নিয়ে ভাবি সখা ও সখীরা বসবে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আম্রপল্লব দিয়ে ওদের মাথায় জল ছিটিয়ে দিবে।তাহলেই ওরা সখা ও সখীতে পরিণত হয় ।এরপরে উভয়ের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া হয়। সখা বা সখীর ছেলে মেয়েরা সখা ও সখীকে তাওই বা মাওই বলে ডাকে। প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এবং বিশেষ করে অসম থেকে প্রচুর লোক এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। লোকমুখে প্রচলিত স্নান পর্বে বাবা বলরামের কাছে কোন কিছু লবন দিয়ে মানত করলে পূর্ণ হয়। হিন্দু,বিশেষ করে কোচ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ হত পিতৃপুরুষদের স্বর্গলাভের আশায় সংরক্ষিত অস্থি গদাধরের জলে ক্ষেপণ করে। ক্ষৌরকাজের দ্বারা মস্তক-মুণ্ডন করে এবং ব্রাহ্মণের মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে তর্পণ করে।
ভক্তদের বাতাসা, উৎসর্গের প্রানিতে ভরে যায় মন্দির। কেউ কেউ দাতব্য দ্রব্য, সোনা, রূপা উপহার্য ইত্যাদি ভক্তি উপহার দেয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ নিজের সেবার জন্য কিছু রেখে বাকি জিনিসগুলি বিক্রি করে দেন। পূর্বে এপার ওপার সংযোগের জন্য বাঁশের মাচা তৈরি করা হতো। বর্তমানে নদীর উপর সেতু নির্মিত হওয়ায় যোগাযোগের নতুন মাত্রা পেয়েছে।
এতত এলাকার সত্তোর্রাদ্ধ গজেন বর্মন বলেন, ১৯৬০-৬২ সালের বিধ্বংসী বন্যায় বাবা বলরামের শিলাবিগ্রহ, রুপোর ষাড়, রাধাগোবিন্দের সোনার বিগ্রহ, কাঁসার ঘন্টা চুরি হয়ে যায়।
বর্তমান পুরোহিত যতীন্দ্রনাথ দেবশর্মা, বংশপরম্পরায় এখানে পুজো করে আসছেন। দেউড়ি হিসেবে আছেন মনো বর্মন। মন্দির পরিচালনা কমিটির অন্যতম কর্তা অমল বর্মন বলেন,২২কাঠা জমির উপর এই মন্দির ও প্রাঙ্গন এবং অনেকটাই খোলামেলা জায়গা এবং জায়গাগুলি সংরক্ষণ এবং পরিচর্যার জন্য সরকারি সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন। মন্দির পরিচর্যা, পূজা-অর্চনা এলাকাবাসীর সক্রিয় সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়। পুরোহিত এবং দেউড়ির বাৎসরিক যৎসামান্য বেতন মন্দিরের এবং বিভিন্ন অনুদান থেকে দেওয়া হয়।
ওখানকার অধিবাসী গুমানাথ বর্মনের পৌত্র শিবনাথ বর্মন বলেন,মন্দিরের কিছু জায়গা তার পূর্বপুরুষ পশুনাথ বর্মন দান করেছিলেন।
ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করা এই মন্দির একপ্রকার অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে এর জৌলুস ফিরলেও পাকাপাকিভাবে এর পরিচর্যা এবং সংরক্ষণ না হলে অদূর ভবিষ্যতে এই মন্দির ইতিহাস হয়ে যাবে।
গন্তব্য :-
৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে দেওচড়াই মোড় বা টোল গেট থেকে উত্তরে ৬ কিলোমিটার দুরে ঘোগারকুটি মৌজায় এই মন্দির অবস্থিত।
তুফানগঞ্জ শহর থেকে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে সোজা পশ্চিমে অন্ধরান ফুলবাড়ি গ্রাম হয়ে ৭/৮ কিলোমিটার আসলেই এই দেবালয়ে পৌঁছানো যায়।
মুক্তেশ্বর শিবমন্দির, সিঙ্গিজানি
মন্দির দর্শন ০৩/০১/২০২২,সোমবার
প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন ফিস ফিস করে পুনরুদ্ধারের হাতছানি দেয়
ইতিহাস সমৃদ্ধ কুচবিহার জেলা়য় প্রাচীন নিদর্শন বা পুরাকীর্তি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে সন্ধান করলেই মিলবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শৈব ভূমি বলে খ্যাত এই ভূখণ্ডে নিশ্চিতভাবে দেবালয় নির্মাণের ক্ষেত্রে শিব মন্দিরের সংখ্যা অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় সংখ্যায় অধিক তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
কুচবিহার সদর থানার ১নং ব্লক মোয়ামারি (Mouamari) অঞ্চলের সিঙ্গিজানি (Singijani) ময়নাগুড়ি, দেওতাপাড়া (Deotapara) গ্রামে প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন এই মুক্তেশ্বর শিবমন্দির (Mukteshwar Shiva temple)। এই মন্দিরের নির্মাণ শৈলী এবং টেরাকোটা কারুকার্য অনেকটা ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধনাথ শিব মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্য। দক্ষিণমুখি এই শিব মন্দিরে প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে সঠিকভাবে তথ্য জানা না গেলেও আনুমানিক ৫০০বছর আগে বা তার পূর্বে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার উক্ত এলাকার বাসিন্দা রথীন বর্মন বলেন, মহারাজা কান্তেশ্বর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকারের ইট এবং ছাপ থেকে অনেকটাই অনুমেয় চতুষ্কোণ গম্বুজযুক্ত অসাধারণ নির্মাণশৈলীর এই মন্দির চতুর্দশ শতকে নির্মিত হয়। যদিও রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের অভাবে মন্দিরের অনেক অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে মন্দিরের উপর অংশে ডুমড়ি গাছ, পাঙুয়া, সোনালু, বটগাছ, পাকড়ি গাছের শেকড় দিয়ে মন্দিরের কাঠামো অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরের অংশে অনেক জায়গায় ফাটল দেখা গেছে । অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং রক্ষণাবেক্ষণের সঠিক পদক্ষেপ বা পদ্ধতি না জানার ফলে এলাকার লোকজন (বেশিরভাগ রাজবংশী) দেবতুল্য এই মন্দির সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তবে তারা যথাসাধ্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন এটিকে আগলে রাখার। কথা বলে যেটুকু বোঝা গেল প্রাচীন মন্দিরটিকে রক্ষার্থে কোনরূপ খামতি বা ত্রুটি রাখেননি। তাদের আগ্রহে হয়তো বা এতোটুকু ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধশালী সম্পদ এখনও বর্তমান আছে। বর্তমানে মন্দির পরিচালন কমিটির তত্ত্বাবধানে (দায়িত্বে আছেন রথীন বর্মন, অঙ্গেশ্বর বর্মন, অনিল বর্মন ) এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এবং সুপরামর্শে মন্দির সংস্কারের উদ্যোগী হয়েছেন।প্রাচীন এই মন্দিরটিকে পুরনো ধাঁচে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই সরকারি সহযোগিতা এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অবশ্যই প্রয়োজন।
মন্দির কমিটির সম্পাদক অঙ্গেশ্বর বর্মন বলেন, এই মন্দিরের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে ২২ কাটা জায়গা এবং সঙ্গে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর। এতত এলাকাটিকে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশাল অর্থের প্রয়োজন এবং তারা মনে করেন, সরকার উদ্যোগ নিলে বা সরকারি সহযোগিতায় প্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত এই মন্দিরটিকে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। তারা দীর্ঘদিনধরে অতিকষ্টে এটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।
মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে শিবলিঙ্গ ও দেবী চণ্ডী। নিত্য পূজা হয় বাবা মহাদেব এবং চন্ডী দেবীর। পূজা করেন স্থানীয় লোকজন। এটাই এখানকার বিশেষত্ব। এছাড়াও রয়েছে একটি নারায়ণ মূর্তি, মূর্তির সঙ্গেই রয়েছে হনুমান, স্বর্গের পরী দুজন, হরিণ্যকুসভ অবতার (বর্তমানে নারায়ণ মূর্তিটি মন্দিরের গর্ভগৃহে থাকেনা,পার্শ্ববর্তী রথীন বর্মনের বাড়িতে এই মূর্তিটি রাখা আছে এবং সেখানেই এর পুজো দেওয়া হয় নিয়মিত)। এছাড়াও এখানকার পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব আদিশক্তির জপ করা হয় এবং তান্ত্রিক শক্তির বলিদানের মাধ্যমে আরাধনা করা হয়। ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি উপলক্ষে দুইদিন মেলা বসে। ভক্তসমাগম হয় প্রচুর। বিভিন্ন জায়গা থেকে পুণ্যার্থীরা এসে বাবা মহাদেবের কাছে মানত করেন এবং মানত সম্পন্ন হলে ভক্তি সহকারে পুজো দেন। এছাড়াও এখানে দুর্গাপূজা, হালযাত্রা, মাশান পূজা, লক্ষ্মী পূজা, মদন কামের বাঁশপূজা, কালী পূজা হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে এখানে বলি দেওয়া হয়। পাঠা, কবুতর, খাসি এই তিন প্রকার প্রাণী দিয়ে বলি নিবেদন করা হয়।
এছাড়া এতত এলাকা এলাকাবাসীরা বলেন, কুচবিহার রাজবংশের মহারাজারা বিভিন্ন সময়ে এখানে এসে মন্দির সংস্কার এবং পূজা নিবেদন করেছেন। তারা আরো বলেন, মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ এবং মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়নকে তাদের পূর্বপুরুষেরা এই মন্দিরে আগমন স্বচক্ষে দেখেছিলেন।
জেলা সদরের সন্নিকটে প্রাচীন এই মন্দিরটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও এটি প্রাচীন সংস্কৃতির ও অতীত ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এগুলোকে সংরক্ষণ করা অবশ্যই প্রয়োজন। এই অমূল্য হেরিটেজ সম্পদ একবার ধ্বংস হয়ে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম এই বিষয়গুলো সম্পর্কে কোন ধারণাই পাবেনা। সরকার বা হেরিটেজ কমিশন প্রাচীন এই মন্দিরটির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব নিলে প্রাচীন এই দেবালয়টি রক্ষা পাবে।এ বিষয়ে এলাকাবাসী ও একমত।
মদনমোহন মন্দির, ফলনাপুর ছিটমহল, সাঙ্গারবাড়ি
Madanmohan Mandir, Falnapur Chitmahal, Sangarbari
মন্দির দর্শন ১৩/০১/২০২২
মদনমোহন মন্দির / বাড়ি (Mdanmohan Mandir, Falnapur Chitmahal, Sangarbari) নামটা আমাদের কাছে খুবই সুপরিচিত। এক কথায় আমরা বলে দেই কুচবিহারের প্রাণের ঠাকুরের মদনমোহন এবং তার রাস উৎসব এর কথা। এছাড়াও তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ মহাকুমায় দেবোত্তর ট্রাস্ট এর নিয়ন্ত্রণাধীন মদনমোহন মন্দিরগুলো তুলনামূলকভাবে জনমানষে পরিচিত। মন্দিরময় বর্তমান সংকুচিত কুচবিহার জেলায় এরকমই আরো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দ্বিতল বিশিষ্ট মদনমোহন মন্দির রয়েছে এই জেলায় আমাদের অনেকেরই অগোচরে, অনাদরে, অযত্নে, অসংরক্ষিতভাবে। এই দেবগৃহের নির্মাণশৈলী, গঠন, আকৃতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখে বোঝা যায় প্রাচীন এই মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোন অংশে কম নয় । আমাদের এই অঞ্চলে ঐতিহাসিক উপাদানের প্রাচুর্যতা থাকলেও কোনো অজানা কারণে বা অনিহার ফলে কুচবিহারের ইতিহাস অনুসন্ধান আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে হয়ে ওঠেনি বলে আমার মনে হয়। তারই ফলশ্রুতি এই মদনমোহন মন্দির। একপ্রকার চরম অবহেলা, উদাসীনতার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই প্রাচীন পুরাসম্পদটি।
Madanmohan Mandir, Falnapur, Sangarbari
প্রাচীন এই মন্দিরটির মালিকানা ছিল স্বর্গীয় উপেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী স্বর্গীয়া সুরবালা রায়চৌধুরী ইস্টেটের। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা কে সঠিকভাবে জানা না গেলেও ওই পরিবারের বর্তমান উত্তরপুরুষ অধীর রায় বলেন, তিনি লোকমুখে এবং পরিবার সূত্রে জেনেছেন এই দ্বিতল দেবালয়টির আনুমানিক বয়স ২৫০-৩০০ বছর হবে এবং তৈরি হয়েছিল কুচবিহার রাজ আমলে (মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছিল কিনা অজানা, হতে পারে মহারাজাদের কাছে উপঢৌকন হিসাবে মন্দিরের দায়িত্ব পেয়েছিল এই পরিবারটি)। ছিটমহল এলাকা হওয়ায় বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন এই মন্দিরটিকে দর্শন করতে পারেননি। ২০১৫ সালের পর বর্তমানে এলাকাটি ভারতের ছিটের অন্তর্ভুক্ত।
পূর্বে দ্বিতল মন্দিরটির উপরতলায় পুজা হত মদন মোহনের বিগ্রহ,রাধা কৃষ্ণ ও শালগ্রাম শিলার। নিচতলায় বাৎসরিক দুর্গাপূজা হত। অসমীয়া ব্রাহ্মণ উমেষ দেব শর্মা এখানে পুজো করতেন । এছাড়াও এখানে বিভিন্ন তিথিতে দোলযাত্রা, রাধাষ্টমী, জন্মাষ্টমীতে পূজা অর্চনা হত এবং বর্তমান সময়ে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এই উৎসব গুলি হয়।
এই মন্দিরের বর্তমান অংশীদার পঙ্কজ রায় এবং অধীর রায় চাকরি সূত্রে ছয় সাত বছর আগে অন্যত্র চলে যাওয়ায় ওই এলাকার বাসিন্দা স্বর্গীয় নিকুঞ্জ বর্মনের পুত্রবধূ মানবী বর্মন নিয়মিত পূজা করে আসছেন রাধাকৃষ্ণের। যদিও মন্দির অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত সুরক্ষা না থাকায় সুধীর রায় মদন মোহনের বিগ্রহ গুলি তার বর্তমান বাসস্থানের নিয়ে এসেছেন এবং সেখানে তিনি নিয়মিত পুজো দেন।
মন্দিরের এই হতশ্রী চেহারা এবং ভগ্নাবশেষ খুবই বেদনাদায়ক। বট গাছের শিকড় মন্দিরটিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। যথেচ্ছ ফাটল ধরেছে মন্দিরের উপরের অংশে। মন্দিরের পাঁচটি চূড়ার মধ্যে চারটি নষ্ট হয়ে গেছে এবং একটি আগাছায় ঢেকে গেছে। এখানকার বাসিন্দা কেউ মন্দিরের চূড়া মাথাভাঙ্গা শহর থেকে দেখা যেত, আবার অনেকে বলেন গোসাইরহাট বাজার থেকে দেখা যেত। অনুমান করা যায়, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের বিধ্বংসী ভূমিকম্প এই মন্দিরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মূলমন্দিরের উপরে উঠার সামনের সিঁড়ি একেবারে ধ্বংস প্রাপ্ত এবং ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন এখনো বর্তমান। শুধু তাই নয় ওই ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরের অনেকটা অংশই নিচে ডেবে যায়। বর্তমানে উপরে উঠার জন্য টেম্পোরারি ভাবে বাসের সিঁড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। নিচের ঘরগুলি রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার না করার ফলে একপ্রকার ধ্বংসের দিকে।
পশ্চিমমুখী এই মন্দিরের ডানদিকে রয়েছে একটি প্রকাণ্ড ইদারা। এখানে ছিলো অনেক প্রাচীন বকফুল, বেল গাছ। জমির পরিমাণ রয়েছে ১০কাঠা। অনেক ভক্ত প্রাণ মানুষ এখানে ছুটে আসেন পুজো দিতে এবং দর্শন করতে।কিন্তু এর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নন। যার ফলে ইতিহাস সমৃদ্ধ এই মন্দির আজও আমাদের লোকচক্ষুর আড়ালে। তিলে তিলে তিলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর কাহিনী। উন্মোচন হোক এর সঠিক ইতিহাস এবং জনমানষে প্রকাশ হোক রাজকাহিনীর আরো একটি গৌরব ও ঐতিহ্য।
বড়বাড়ি শিব মন্দির / রায় বসুনিয়া পরিবারের বড়বাড়ির দ্বিতীয় জল্পেশ মন্দির
Borobari Shiva Mandir – Roy Basunia Family
মন্দির দর্শন ১৭/০১/২০২২
শৈবভূমি কুচবিহার জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন শিব মন্দির। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বা বেসরকারি তত্ত্বাবধানে এই মন্দিরগুলির পূজা অর্চনা হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আবার কিছু কিছু প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মন্দির রয়েছে একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। অনুসন্ধান সাপেক্ষে এরকম একটি প্রাচীন মন্দিরের প্রতি অবজ্ঞা এবং উদাসীনতা দেখে যারপরনাই মর্মাহত হলাম। শতবর্ষ প্রাচীন স্বর্গীয় ধৈর্য্য নারায়ন রায় বসুনিয়া, স্বর্গীয় ধর্ম নারায়ন রায় বসুনিয়া, স্বর্গীয় দ্বারিকা নারায়ন রায় বসুনিয়া, স্বর্গীয় ধর্ম নারায়ন রায় বসুনিয়া, স্বর্গীয় খগেন্দ্র নাথ রায় বসুনিয়া পরিবারের জল্পেশ মন্দিরের আদলে নির্মিত শিব মন্দির শুধু একটি ইতিহাস নয়, “জীবন্ত ইতিহাস”। এই মন্দির সুদূর অতীতকে আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ফুটে তোলে। এরকম একটি অজ্ঞাত এবং বিস্তৃত প্রায় “জীবন্ত ইতিহাস” জেলার পুরাকীর্তির একটি অন্যতম অমূল্য সম্পদ।যথাযথ প্রচার এবং সংস্কার এর অভাবে এই অমূল্য সম্পদটি যেমন লোকচক্ষুর আড়ালে ঠিক তেমনি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের এর দিকে এগিয়ে চলেছে।
Borobari Shiva Mandir - Roy Basunia Family
কুচবিহার রাজআমলে জোতদার ভুক্ত এই রায় বসুনিয়া পরিবারটির অনেক নামডাক ছিল। বিশাল ভূসম্পত্তির অধিকারী ছিলেন এই পরিবারটি। ভারতভুক্তি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি সংস্কার আইনের ফলে এই পরিবারের অনেক সম্পত্তি ভেস্ট হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যায় এই পরিবারটি। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে গেলেও তারা সাধ্যমত এই মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন এবং শিব মন্দিরে পূজা অর্চনা করেছিলেন ইতিপূর্বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মন্দিরের সংস্কার তাদের সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় তারাও চাইছেন সরকারি উদ্যোগে এই মন্দিরটির সংস্কার হোক। রক্ষা পাক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ইতিহাস।
বর্তমানে মন্দিরটিতে শুধুমাত্র শিব চতুর্দশীতে শিব বিগ্রহটি নিয়ে আসা হয়, সঙ্গে নিয়ে আসা হয় গণেশ এবং ষাড়ের বিগ্রহ। প্রচুর ভক্তসমাগম হয় ওই দিনে। বাকি দিনগুলোতে বিগ্রহগুলির নিত্য পূজা হয় বাড়ির মধ্যে এবং পূজা দেন বাড়ির লোকজন। পূর্বে এখানে নলবাড়ির অসমীয়া ব্রাহ্মণ উৎসবদেব শর্মা বংশপরম্পরায় পুজো দিয়ে এসেছেন। একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা হয়ে যাওয়ার ফলে শর্মা পরিবারটি এখানে পূজা করা বন্ধ করে দেন।
দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটিতে সংস্কার না হওয়ার ফলে মন্দিরটির অবস্থা প্রায় ভগ্নপ্রায়। বাইরের এবং ভেতরের দেয়াল থেকে (একবার সংস্কার করলেও ) প্লাস্টার খুলে পড়ছে। মন্দিরের চূড়ায় ত্রিশূল থাকলেও তা আগাছায় ঢেকে যাচ্ছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে মেঝের অবস্থা খুবই দৈন্যদশা। প্রয়োজনীয় সুরক্ষা না থাকায় মন্দিরের বিগ্রহ গুলি বাড়িতে রাখা আছে।
রায় বসুনিয়া পরিবারের বর্তমান ষাটোর্ধ্ব সদস্য গৌতম রায় বসুনিয়া বলেন, তিনি শুনেছেন বহুকাল পূর্বে থেকে তাদের বাড়িতে তাদের পূর্বপুরুষেরা শিবের আরাধনা করত মহা ধুমধাম করে। তার স্বর্গীয়া ঠাকুমা বিমলাবালা রায় বসুনিয়া (স্বর্গীয় গিরীন্দ্র প্রসাদ রায় বসুনিয়ার স্ত্রী) আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে জল্পেশ মন্দিরের আদলে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন এবং মন্দির নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে কাশীধাম থেকে শিবের বিগ্রহ নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন গণেশ এবং ষাঁড়ের বিগ্রহ। ধুমধাম করে শিবরাত্রিতে পুজো হত সেই সময়। চার প্রহরে পুজা হত শিবরাত্রিতে। চতুর্থ প্রহরে অন্নভোগ দেওয়া হতো।শিবরাত্রি পরের দিন পাশের কালীমন্দিরে পাঁঠা বলে দিতেন। যদিও বর্তমানে এই পরিবারে বলি প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে।
অতীতের স্মৃতিকে আলোকপাত করতে করতে তিনি আরো বলেন কুচবিহার রাজদরবারে যথেষ্ট সম্মান পেতেন তার পূর্বপুরুষরা। “পুন্যাহ” উৎসবের (আর্থিক বছরের শেষে, সাধারণত মে মাসে) সময় মহারাজাদের উপস্থিতিতে রাজদরবারে তার পূর্ব পুরুষেরা তাদের জোতের খাজনা বা নজর দিতেন। খুব ভালো সম্পর্ক ছিল রাজবাড়ী সঙ্গে তাদের পরিবারের। ঘোড়সওয়ার করে তাড়া রাজবাড়ীতে উপস্থিত হতেন এবং বিভিন্ন সময়ে দরবার থেকে তারা উপঢৌকন পেতেন।
ওই অঞ্চলের প্রভাবশালী রায় বসুনিয়া পরিবারটির সুখ্যাতি এখনো লোকমুখে প্রচলিত। ওই পরিবারের আরেকজন বর্তমান সদস্য জগৎ জীবন রায় বসুনিয়া বলেন, পূর্বে তাদের বাড়িতে অনেক হাতি ছিল, অনেক কর্মচারী ছিল, বাড়ি পাহাড়া দেওয়ার জন্য অনেক দারোয়ান ছিল, ব্রাহ্মণদের পাকাপাকিভাবে বাসস্থানের জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছিল তার পূর্ব পুরুষেরা, বিঘার পর বিঘা তাদের পুকুর ছিল। যদিও ভূমি সংস্কার আইনের ফলে এগুলি তাদের পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়।
ক্ষেতী ফুলবাড়ী ( Kheti Fulbari) অঞ্চলের এই পরিবারটি ক্রমান্বয়ে বড় হতে থাকে। বর্তমান উত্তরাধিকারীগণ তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে বসবাস করছেন। জমি জায়গা গুলির তাদের মধ্যে শরিকি ভাগ হয়ে যায়। শরিকি ভাগ হয়ে গেলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত এই শিব মন্দির সম্পর্কে তারা খুবই সচেতন এবং আগ্রহী। এখনো তারা নিয়মনিষ্ঠা করে বাড়িতেই পূজা অর্চনা করেন ।
উল্লেখ্য যে, এই পরিবারের স্বর্গীয় তারকেশ্বর রায় বসুনিয়ার কন্যা রাধারানী রায় বসুনিয়া (বর্মন) কুচবিহারের স্বনামধন্য ব্যক্তি, বিশিষ্ট আইনজীবী রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রাক্তন সদস্য স্বর্গীয় প্রসেনজিৎ বর্মন এর সহধর্মীনি ছিলেন।
শতবর্ষ প্রাচীন শিব মন্দিরকে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে জেলার পর্যটন মানচিত্রে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। নতুবা এই প্রাচীন পুরাসম্পদটি লোকচক্ষুর আড়াল থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
মন্দির দর্শনে আমার সঙ্গে ছিলেন প্রিয় ভাই আবির ঘোষ এবং ভাই সৌরভ বর্মন।