দেবী কামাখ্যা মন্দিরের ইতিহাস এবং কুচবিহার রাজবংশ।

VSarkar
0

জয় মা কামাখ্যা

kamakhya temple

দেবী কামাখ্যার অম্বুবাচী তিথি উপলক্ষে কামাখ্যা মন্দির তিন দিন বন্ধ থাকবে। মন্দিরের দ্বার খুলে স্নান, পূজাদি সম্পন্ন করা হবে চতুর্থ দিনে। সকলকে পবিত্র অম্বুবাচীর শুভেচ্ছা জানাই।

Written by: Kumar Mridul Narayan

কামাখ্যা মন্দির (Kamakhya Temple)  হল ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি  (Guwahati) শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দু দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। ৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটিতে এবং ৪টি আদি শক্তি পিঠগুলির মধ্যে, কামাখ্য মন্দিরটি বিশেষ কারণ দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি এখানে পড়েছিল এবং এইভাবে দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বা “রক্তক্ষরণকারী দেবী” বলা হয়। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার (Dashmahabidya) মন্দিরও আছে। এই মন্দিরগুলিতে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ কালী , তারা , ষোড়শী , ভুবনেশ্বরী , ভৈরবী , ধূমাবতী , ছিন্নমস্তা ,বগলামুখী , মাতঙ্গী ও দেবী কমলা – এই দশ দেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী (Tripurasundari), মাতঙ্গী (Matangi) ও কমলা (Kamala) প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। অন্যান্য দেবীদের জন্য পৃথক মন্দির আছে। হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।

Kamakhya temple layout

Kamakhya Temple Layout

প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে (৩৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং সপ্তম শতাব্দীর চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং-এর (Hiuen-Tsang) রচনাতেও কামাখ্যা উল্লেখিত হয়েছে। সেই সময় কামাখ্যাকে অব্রাহ্মণ কিরাত (Kirat) জাতীয় উপাস্য দেবী মনে করা হত। নবম শতাব্দীতে ম্লেচ্ছ রাজবংশের (Mleccha dynasty) বানমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার শিলালিপি-উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, সুলেমান কিরানির (১৫৬৬-১৫৭২) সেনাপতি কালাপাহাড় (Kalapahar) এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (Alauddin Hussain Sah) কামতা রাজ্য (Kamata State) আক্রমণ করার সময় (১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কথিত আছে, কোচ  তথা কামতাপুর রাজবংশের (Koch dynasty) প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ এই ধ্বংসাবশেষ খুজে পান। তিনিই এই মন্দিরে পূজার পুনর্প্রবর্তন করেন। তবে তার পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়। পুনর্নির্মাণের সময় পুরনো মন্দিরের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড়ো করে তোলেন। অন্যান্য মন্দিরগুলি পরে নির্মিত হয়।

কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে: গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ (যেগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির)। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলির স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলিতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে। নিম্ন আসামের বহু মন্দিরে এই ধরনের চূড়া দেখা যায়। গর্ভগৃহটি আসলে ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত দেখা যায়।

গর্ভগৃহটি ছোটো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়াই সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়। ভিতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে যেটি যোনির আকৃতিবিশিষ্ট। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্ত দেখা যায়। একটি ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত এবং দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরগুলিতেই একই রকম যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায়, যা ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনের জল দ্বারা পূর্ণ।

বর্তমান মন্দির ভবনটি অহোম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত। এর মধ্যে প্রাচীন কোচ স্থাপত্যটি সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ১৫৬৫ সাল নাগাদ  মহারাজা নরনারায়ণ এর ভ্রাতা চিলরায় মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অনুসারে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে দেন। এখন যে মৌচাক-আকারের চূড়াটি দেখা যায়, তা নিম্ন আসামের মন্দির স্থাপত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন্দিরের বাইরে গণেশ ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি খোদিত আছে। মন্দিরের তিনটি প্রধান কক্ষ। পশ্চিমের কক্ষটি বৃহৎ ও আয়তাকার। সাধারণ তীর্থযাত্রীরা এটি পূজার জন্য ব্যবহার করেন না। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার। এখানে দেবীর একটি ছোটো মূর্তি আছে। এই মূর্তিটি পরবর্তীকালে এখানে স্থাপিত হয়। এই কক্ষের দেওয়ালে নরনারায়ণ (Naranarayan), অন্যান্য দেবদেবী ও তৎসম্পর্কিত শিলালেখি খোদিত আছে। মাঝের কক্ষটিই মূল গর্ভগৃহে নিয়ে যায়। এটি গুহার আকৃতিবিশিষ্ট। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর ও ভূগর্ভস্থ প্রস্রবনটি আছে। প্রতিবছর বর্ষাকালে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করা হয়। এই সময় মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবনের জল আয়রন অক্সাইডের প্রভাবে লাল হয়ে থাকে। ফলে এটিকে ঋতুস্রাবের মতো দেখতে হয়। প্রাচীনকালে কামাখ্যা ছিল খাসি উপজাতির (Khasi tribes) বলিদানের জায়গা। এখনও বলিদান এখানে পূজার অঙ্গ। এখানে অনেক ভক্তই দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগল বলি দেন।

maa kamakhya mandir

Kamakhya Temple, Nilachal hill, Guwahati

১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নীলাচল পর্বতে মোঙ্গোল আক্রমণকালে প্রথম তান্ত্রিক কামাখ্যা মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় তান্ত্রিক মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল মুসলমান আক্রমণের সময়। আসামের অন্যান্য দেবীদের মতো, দেবী কামাখ্যার পূজাতেও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখা যায়। দেবীকে যেসব নামে পূজা করা হয় তার মধ্যে অনেক স্থানীয় আর্য ও অনার্য দেবদেবীর নাম আছে। যোগিনী তন্ত্র অনুসারে, এই যোগিনী পীঠের ধর্মের উৎস কিরাতদের ধর্ম। বাণীকান্ত কাকতির মতে, গারো (Garo tribes) উপজাতির মানুষেরা কামাখ্যায় শূকর বলি দিত। এই প্রথা মহারাজা নরনারায়ণ-কর্তৃক নিযুক্ত পুরোহিতদের মধ্যেও দেখা যেত। কামাখ্যার পূজা বামাচার ও দক্ষিণাচার উভয় মতেই হয়। সাধারণত ফুল দিয়েই পূজা দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে পশুবলি হয়। স্ত্রীপশু বলি সাধারণত নিষিদ্ধ গণ্য হলেও, বহু পশুবলির ক্ষেত্রে এই নিয়মে ছাড় দেওয়া হয়।

কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ (Maharaja Naranarayan) এবং তার ভ্রাতা চিলারায় (Chilaray) মা কামাখ্যার বিশেষ ভক্ত ছিলেন। কথিত আছে, সন্ধ্যা আরতির সময় বাজনা শুরু হলে কামাক্ষা দেবী স্বয়ং নগ্নমূর্তিতে আবির্ভূত হতেন এবং বাজনার তালে তালে নৃত্য করতেন। একদিন মহারাজ কেন্দুকলাই (Kendukalai) নামক পূজারী ব্রাহ্মণ এর সাহায্যে আড়াল থেকে নৃত্যরতা দেবীকে দর্শন করেন। এর জন্য মা কামাখ্যা দেবী  অসন্তুষ্ট হয়ে অভিশাপ দেন যে, “রাজ পরিবারের কেউ কামাখ্যা মন্দির দর্শন করতে পারবেন না । রাজবংশের যিনি কামাক্ষা মন্দির দর্শন  করবেন তিনি বা তার পরিবার মৃত্যুমুখে পতিত হবেন।” রাজার মৃত্যু দর্শনের মুহূর্তেই পূজারী ব্রাহ্মণ কেন্দু কলাই এর মৃত্যু হয়। কেন্দু কলাইয়ের প্রস্তুরীকৃত দেহ এখনো মন্দির চত্বরে আছে। অভিশাপপ্রাপ্ত  হয়ে মহারাজা নরনারায়ণ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করে বলেন যে, তার অপরাধে তার বংশধরদের মূর্তি দর্শন ও পূজা দেওয়া হবে না। এতে মা সদয় হয়ে বলেন তিনি বানেশ্বর শিব মন্দির (Baneshwar Shiva temple) এর কাছে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের (Siddheshwari temple) দেবী বিগ্রহ এবং পাশে কামরাঙ্গা বৃক্ষে দেবীরূপে সর্বদা অবস্থান করবেন। মহারাজগন এবং তার বংশধরেরা সেখানে পূজা দিলে ও দর্শন করলে মা কামাখ্যার পুজা ও দর্শন হবে।

মহারাজা নরনারায়ণের পরবর্তী সময়ে কোনো মহারাজা বা তার বংশধরেরা কামাখ্যা মন্দির দর্শন  করেননি । তবে সেই সময় থেকেই কামাখ্যা দেবীর প্রতি অম্বুবাচী এবং শারদীয় পূজার নির্মাল্য নিয়মিতভাবে কুচবিহারে পাঠানো হতো ।

কুচবিহার রাজবংশের জ্ঞাতি  তথা রাজগন হওয়াতে আমরা কামাখ্যা মায়ের দর্শন এবং পূজা থেকে চিরবঞ্চিত।


# Coochbehar and Kamakhya temple connection # History of Coochbehar and Maa Kamakhya Temple

তথ্যসূত্র -:

  • আমানাতউল্লাহ খাঁ র কোচবিহারের ইতিহাস, ভগবতীচরন বন্দ্যোপাধ্যায়ের  কোচবিহারের ইতিহাস, হিমাদ্রিশংকর  ভট্টাচার্যের কোচবিহার ও প্রাচীন প্রথার কিছু জানা অজানা কথা ।

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)