তুফানগঞ্জের বিশিষ্ট গবেষক ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকার [ Kshitish Ch. Sarkar ]
মাননীয় ক্ষিতীশ চন্দ্র সরকার (Sh. Kshitish Ch. Sarkar) তুফানগঞ্জ নৃপেন্দ্র নারায়ণ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের (Tufanganj Memorial High School) প্রাক্তন শিক্ষক ছিলেন। বাড়ি তুফানগঞ্জ শহরের পশ্চিমে দড়িয়া বালাই রোডে বটতলা (অন্ধরান ফুলবাড়ি ১) নামক এলাকায়। মাননীয় ক্ষিতীশ বাবু জন্মগ্রহন করেন বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলায়। দেশভাগের পর সপরিবারে এদেশে চলে আসেন। ওঁনার পরিচয় শুধু একজন শিক্ষক হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও ওঁনার অধ্যবসায় বিস্মিত করার মত। তুফানগঞ্জ নৃপেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুলে ছাত্রাবস্থায় ওঁনাকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার ছাত্রজীবনে ওঁনার গুরুত্ব অপরিসীম। উনি ইংরাজী ও ইতিহাস এই দুই বিষয়ে সাধারনত ক্লাস নিতেন। খুবই কড়া ধাচের শিক্ষক ছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা উনি খুবই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখতেন, যতিচন্হের এদিক ওদিক হলেই নম্বর কাটা যেত, ক্লাসে শেখাতেনও যত্নসহকারে। একজন মানুষ হিসেবে ওঁনার তুলনা নেই, ওঁনার জ্ঞান ও অধ্যবসায় সত্যিই অবাক করার মতো। ওঁনার লেখা "In Quest of Roots" কোচ রাজবংশী কামতাপুরী সমাজের একটা মাইলস্টোন বলা যেতে পারে। সামাজিক কাজকর্মেও উনি বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন। তুফানগঞ্জের সারদা শিশু তীর্থ স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম কর্ণধার ছিলেন। বিদ্যাভারতী প্রতিষ্ঠারও নেতৃত্বে ছিলেন।
TRIONER, In Quest of Roots
উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত নৃতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি গবেষক হিসাবে মাননীয় ক্ষিতীশ চন্দ্র মহাশয় বিশেষ আসন অলংকৃত করেছিলেন। তিনি TRIONER অর্থাৎ Tribal Research Institute of North East Region এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন। উত্তর পূর্ব ভারতের জনজাতিদের এবং কোচ রাজবংশীদের নৃতাত্ত্বিক, উৎপত্তি ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর লেখা বই "In Quest of Roots" একটি অনবদ্য আকরগ্রন্থ। তিনি তাঁর সৃষ্টির জন্য ২০১৮ সালে "অমিয়ভূষণ মজুমদার স্মৃতি" পুরষ্কারে সন্মানিত হন। গবেষণার কাজে মেঘালয়, আসাম, নেপাল যখন যেখানে দরকার সেখানে পৌঁছে যেতে তাঁর উদ্যম ও আগ্রহ ছিল তুলনাহীন। বয়স শরীর স্বাস্থ্য কোনো সময় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি ওঁনার। ভীষন তথ্যপিপাসু ছিলেন। গবেষণার কাজে লাগবে এরকম কোনো বই বা নথির সন্ধান পেলে সেটি উনি সংগ্রহ করতেনই।
উত্তর পূর্ব ভারতের জনজাতি সম্পর্কে যেকোন বিষয়ে বিশেষত কোচরাজবংশীদের ভাষা সংস্কৃতি বিষয়ে কোন গবেষনার জন্য বা কোন নিবন্ধ প্রবন্ধ লেখার জন্য কেউ যদি ওনার কাছে তথ্যগত সাহায্য চাইতেন তবে তিনি তাকে ফেরাতেন না, বরং খুশি হয়ে তাকে অকুন্ঠভাবে তথ্য সাহায্য করতেন। উনি সবসময় চাইতেন নতুন প্রজন্মের লেখক গবেষক উঠে আসুক যারা তথাকথিত গতানুগতিক ধারার লেখক বা গবেষক হবেন না। তিনি চাইতেন যে লেখক বা গবেষকগন একদম ফিল্ডে কাজ করে তথ্য সংগ্রহ করে আনবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এমনকি অনেক অধ্যাপকগনের তথ্যকেন্দ্র বা তথ্যের ভান্ডার ছিলেন তিনি। ভীষন যুক্তিবাদী ছিলেন তিনি, বিজ্ঞান ভিত্তিক তথা ঐতিহাসিক নথিছাড়া কোনো সময়ই কোনো মন্তব্য করতেন না। খুবই গভীরভাবে বিষয়গুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতেন। একেবারেই প্রচার বিমুখ ছিলেন। তিনি ৭জুন ২০২১, রাত ১২টা ৫০ মিনিটে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরোলোক গমন করেন। উনি চলে যাওয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনজাতি বিশেষত কোচ রাজবংশীদের উৎপত্তিগত নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক গবেষণায় অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেল।