গৌরিপুরের মাটিয়াবাগের হাওয়াখানা বা মাটিয়াবাগের রাজবাড়ি, জেলা – ধুবরী / Gauripur Palace or Hawakhana of Matiabag or Matiabag Palace – Dhubri District
অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় কামতা-কুচবিহার রাজবংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবার বা জমিদার এর আত্মীয়তা, যোগসুত্র যেমন ছিল ঠিক তেমনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পারিবারিক সম্পর্কের বাইরেও এই সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। ধুবরী জেলার (Dhubri district) গৌরিপুর রাজবাড়ি (Gauripur Palace) তথা গৌরীপুর জমিদার বা রাজপরিবারের সঙ্গে কুচবিহার রাজবংশের রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও যোগসূত্র ছিল বিশ্বসিংয়ের আমল থেকে। গৌরিপুর রাজবাড়ি মাটিয়াবাগের রাজবাড়ি (Matiabag Palace) বা মাটিয়াবাগের হাওয়াখানা (Matiabag Hawakhana) নামেও পরিচিত।
গৌরীপুর রাজপরিবারের (Gauripur Royal Family) পূর্বপুরুষ নরহরি রায় (Narahari Roy) বা কোবিন্দ পাত্র (চিলা রায়ের পুত্র রঘুদেব নারায়নের মন্ত্রী ছিলেন) এদের সঙ্গে যোগাযোগের যে সূচনা হয়েছিল, পরবর্তীতে প্রতাপচন্দ্র বড়ুয়ার পোষ্যপুত্র প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়ার কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুরের (Maharaja Nripendra Narayan Bhupbahadur) তত্ত্বাবধানে রাজকার্য পরিচালনার দক্ষতা এবং পারদর্শী অর্জন করা এবং শেষ রাজা প্রকৃতেশ চন্দ্র বড়ুয়া কুচবিহার মহারাজের সঙ্গে শিকার যাত্রায় অংশগ্রহণ, দুই পরিবারের সম্পর্কের গভীর মেলবন্ধন বলে দেয়। এমনকি কুচবিহার মহারাজার রাজ্যভিষেক এর সময় গৌরীপুর থেকে রাজা অনেক উপঢৌকন নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। গায়ত্রী দেবীর আমন্ত্রণে তারা জয়পুরের রামবাগ প্যালেসে গিয়েছিলেন।
Coochbehar and Gauripur Royal family members
কুচবিহারের রাজদুয়ারবক্সী অমিয়দেব বক্সীর সঙ্গে গৌরীপুরের বড়ুয়া পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল।এছাড়াও আরো বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিশাল ব্যাপ্তী ছিল, যা বলে শেষ করা যাবে না। ভারতভুক্তির চুক্তি, রাজ্য ভাগ, প্রজাতন্ত্রী থেকে গণতন্ত্রীতে পরিণত হওয়ার ফলে কুচবিহারের সঙ্গে গৌরীপুরের সম্পর্কের একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। একদিকে আসাম অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ, মাঝখানে একটা সীমানা এবং সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় খামতিও থেকে যায়। কিন্তু যোগাযোগ কোনোকালেই বন্ধ ছিল না এবং আশা রাখছি এই যোগাযোগ, এই মেলবন্ধন আগামীতেও অটুট থাকবে আমার চির বিশ্বাস।
গৌরিপুর রাজবাড়ি বা মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি বা হাওয়াখানা / Gauripur Palace or Matiabag Palace or Hawakhana
মাটিয়াবাগ (Matiabag) পাহাড়ের চূড়ায় এবং গদাধর নদীর (River Gadadhar) তীরে অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন গৌরিপুর রাজবাড়ি (Gauripur Palace / হাওয়াখানা) বা মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি (Matiabag Palace) নামেও পরিচিত। এটি ধুবরী থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে এবং গুরুতেগবাহাদুর রোড হয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানো যেতে পারে।
রাজা প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া (Raja Prabhat Chandra Barua) কর্তৃক নির্মিত রাজবাড়ীটি চীনা স্থপতিদের দ্বারা তৈরী করা হয়েছিল। মুঘল এবং ব্রিটিশ শৈলীর স্থাপত্যশৈলীকে একত্রিত করে এই প্রাসাদটির বিস্ময়কর অংশটি তৈরি হয়েছিল। গৌরীপুর রাজবাড়ী (হাওয়াখানা) নির্মাণ ১৯০৪ সালে শুরু হয় এবং ১৯১৪ সালে শেষ হয়, তৎকালীন পুরো নির্মাণে প্রায় তিন লাখ চল্লিশ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল।
প্রাসাদটি প্রাথমিকভাবে বিশেষ অতিথিদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু পরে এটি রাজপরিবারের উত্তরসূরিদের স্থায়ী আবাস হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল, এই প্রাসাদেই বিখ্যাত পরিচালক প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া, (Pramathesh Chandra Barua) শেষ রাজা প্রকৃতেশ চন্দ্র বড়ুয়া (Prakritesh Chandra Barua) থাকতেন, এছাড়াও প্রখ্যাত গোয়ালপাড়িয়া লোকগীত গায়িকা প্রতিমা বড়ুয়া পান্ডে (Pratima Barua Pandey) বাস করতেন। হস্তীর কন্যা পার্বতী বড়ুয়া (Hastir kanya Parbati Barua) গৌরীপুরে (Gauripur) আসলে এই বাড়িতেই থাকেন ।বর্তমানে এই বাড়িতে প্রবীর বড়ুয়া (Prabir Barua), পার্বতী বড়ুয়ার স্বামী ও প্রবীর বড়ুয়ার আর এক ভাই থাকেন।
Film Director Pramathesh Barua
এই বাড়িটি মূলত গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ হিসাবে ব্যবহৃত হত এবং এর গৌরবময় দিনগুলিতে প্রাসাদটি দুর্দান্ত এবং প্রাণবন্ত অবস্থান ছিল। এটি এখনও স্থাপত্যের একটি সুন্দর অংশ এবং যারা এই স্থানটির ইতিহাস সম্পর্কে জানেন তারা এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখার জন্য কাছাকাছি এবং দূর থেকে ছুটে আসেন। প্রাসাদে একটি মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে রাজপরিবারের অনেক জিনিসপত্র এবং সম্পত্তি রয়েছে, শিকার করা প্রাণীর শিং এবং অন্যান্য প্রাচীন বস্তূ রয়েছে। এছাড়াও পরিবারের অন্তর্গত এবং বহু শতাব্দী আগের বন্দুক,ছোটো কামান,স্হল যুদ্ধের সামগ্রী রয়েছে। সামগ্রিকভাবে আসাম রাজ্যের অভিযাত্রীদের তালিকায় গৌরীপুর রাজবাড়ি (হাওয়াখানা) (Gauripur Palace) একটি দর্শনীয় স্থান। প্রাসাদটি এখনও এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং সম্মানের জায়গা।
গৌরীপুর নামকরণের ইতিহাস / History of Gauripur Nomenclature
জনশ্রুতি অনুসারে, শহরটির প্রতিষ্ঠা এবং “গৌরীপুর” নামটির সাথে গৌরীপুরের প্রধান স্থপতি, রাঙ্গামাটির জমিদার রাজা প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার (Raja Pratap Chandra Barua) সাথে একটি মজার গল্প জড়িত। একদিন রাজা প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়া (তৎকালীন গৌরীপুরের শাসক) বনে শিকার করছিলেন এবং একটি ব্যাঙ দেখতে পান যেটি একটি সাপ খাচ্ছে। এই অপ্রাকৃতিক ব্যাপারটা দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। দেবী মহামায়ার অত্যন্ত শক্তিশালী ভক্ত হওয়ার কারণে, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি তাঁর জন্য মহামায়ার বার্তা। পরবর্তীকালে, তিনি দেবী মহামায়ার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং মহামায়ার “গৌরী” এর নামানুসারে স্থানটির নাম দেন গৌরীপুর। এমনকি তিনি তার জমিদারির রাজধানী রাঙ্গামাটি থেকে গৌরীপুরে স্থানান্তরিত করেন।
গৌরীপুর রাজপরিবারের শেষ রাজা প্রকৃতেশ চন্দ্র বড়ুয়ার সুযোগ্য পুত্র মিষ্টভাষী প্রবীর বড়ুয়া (অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক) মহাশয় তার পূর্বপুরুষদের স্মৃতিগুলি সুন্দর ভাবে আগলে রেখেছেন। পারিবারিক রাজকীয় রীতিনীতি, পূজা অর্চনা নিয়মমাফিক ভাবে বংশানুক্রমিকভাবে করে চলেছেন। ওনার মিশুকে আচরণ, সরল আতিথিয়তা দর্শনার্থী পর্যটকদের একটা বাড়তি পাওনা। ওনার সুযোগ্য উত্তরসূরি কন্যা পুনম বড়ুয়া (Punam Barua – Bhawaiya Singer) ভাওয়াইয়া এবং লোকগীতিতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। বিবাহসূত্রে তিনি এখন গৌহাটিতে থাকেন।
গৌরিপুর রাজবাড়ি – মিউজিয়াম / Gauripur Palace Museum
ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রবীর জেঠুর যোগাযোগ ও কথোপকথনের ফলে কুচবিহার রাজবংশের সঙ্গে গৌরীপুর রাজবাড়ির পূর্বের অনেক অজানা কথা, ইতিহাস জেনেছি। কয়েকবার যাওয়ার এবং দেখা করার সুযোগ হয়েছে। ওনার সদা হাস্য মুখ, ভালোবাসা, আতিথিয়েতা এবং আন্তরিকতা আমার জীবনের অন্যতম উপহার। সুযোগ পেলেই যেতে ইচ্ছে করে মাটিয়াবাগের প্রাসাদে। ওখানকার মনোরম পরিবেশ, বাড়ির সম্মুখে রঘুদেবনারায়ন নামাঙ্কিত কামান, শিব মন্দির, গদাধর নদী এবং প্রাসাদের দোতলার দালান এক অনন্য অনুভূতি। সেইসঙ্গে গৃহকর্তার আবদার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে।
See images of Gauripur Palace Museum
বর্তমান আসাম সরকার মাটিয়াবাগের হাওয়াখানা, মূল রাজবাড়ী, এই পরিবারের বিভিন্ন স্থাপত্য সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। হয়তো এগুলোকে পরবর্তীতে পর্যটনকেন্দ্র, সংগ্রহশালা হিসেবে দর্শনার্থীদের কাছে উন্মুক্ত করবে। হরেকরকম চাকচিক্য, সংস্কার ও আধুনিকতার মিশেলে পুনঃসংস্কার করবে। তবে আশা রাখবো সংস্কারের নামে স্থাপত্যের যেন কোনো বিকৃতি না ঘটানো হয়। তবে একবার অধিগ্রহণ হয়ে গেলেই হয়তো আগামীদিনে টিকিট কেটে দর্শন করতে হবে। এটাও অনেকটা বেদনার। খুব আশাবাদী আমি আগামীতে যা কিছু হবে সব ভালই হবে।
কুচবিহার আসাম প্রগাঢ় সম্পর্কের মেলবন্ধন চিরকাল এভাবেই অটুট থাকুক। বেঁচে থাকুক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবগাঁথা।