মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ এর কর্মকান্ড।

VSarkar
0
Maharaja Nripendra Narayan

মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপবাহাদুর ও তাঁর কর্মকান্ড

লিখেছেন: কুমার মৃদুল নারায়ণ

আধুনিক কুচবিহারের স্রষ্টা মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভুপ বাহাদুর পাঁচশত বছরের কোচ রাজত্বের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তার মহতী কাজের মাধ্যমে। শাসকের আচার-আচরণের  উপর নির্ভর করে রাজ্যের প্রজা মঙ্গলের উন্নতি। প্রজা- হিতৈষী বিদ্যোৎসাহী, সুগভীর কর্তব্যনিষ্ঠ, স্নেহ পরায়ণ এবং  পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবনায় কুচবিহার রাজ্যের সর্ববিধ উন্নতি তিনি করেছিলেন। তার আমলে কুচবিহার রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার আসে। তিনি পরিকল্পনা করে কুচবিহার শহর সহ রাজ্যের শহরগুলি এবং রাস্তাগুলি সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করে  নির্মাণ করেন। তিনি কুচবিহারের হাইকোর্ট, জজকোর্ট ট্রেজারি কমিশনার অফিস, স্কুল ইনস্পেক্টর অফিস, পুলিশ অফিস, এসডিও অফিস, রেজিস্ট্রেশন অফিস স্থাপন করেন এবং এগুলির জন্য ভবন নির্মাণ করেন। এসব কারণেই মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণকে আধুনিক কুচবিহারের রূপকার বলা হয়। 

কর্নেল হিজ হাইনেস  মহারাজা স্যার নৃপেন্দ্রনাথ নারায়ণ ভুপবাহাদুর, জি.সি.আই.ই, সি.বি, এ.ডি. সি ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ৪ঠা অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন।

রাজকুমার নৃপেন্দ্র নারায়ণ যখন দশ মাস বয়স ছিল তখন তার পিতা মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ ১৮৬৩ সালে মারা যান। তিনি ঐ বছরেই মহারাজা হিসেবে কুচবিহার রাজ্যের রাজতন্ত্র পালন করেছিলেন। যেহেতু তিনি শিশু ছিলেন সেহেতু প্রশাসন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করেন। তার বড় ভাই ছিলেন মহারাজকুমার যতীন্দ্র নারায়ণ এবং তাঁর বৈমাত্রেয় দিদি রাজকন্যা আনন্দময়ী দেবী ছিলেন পাঙ্গা জমিদারির  রানী। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বেনারসে ওয়ার্ডস ইন্সটিটিউট এ অধ্যয়ন করেন, তারপরে বাঁকিপুর কলেজ, পাটনা এবং শেষপর্যন্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন নিয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের বিদুষী কন্যা সুনিতী দেবীকে বিয়ে করেন। বিয়ের অবিলম্ব পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে চলে যান। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করেন।

তিনি চার পুত্র ও তিন কন্যার পিতা ছিলেন এবং তাঁদের নামগুলি হল- যুবরাজ রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ, মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ, মহারাজকুমার ভিক্টর নৃত্যেন্দ্র নারায়ণ, প্রিন্স হিতেন্দ্র নারায়ণ এবং রাজকন্যা প্রতিভা দেবী, রাজকন্যা সুধীরা দেবী এবং রাজকন্যা সুকৃতি দেবী। পরে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ পরবর্তী মহারাজা হন এবং তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করলে ভাই মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ পরে কুচবিহার রাজ্যের মহারাজা হন। মহারাজকুমারী ইলা দেবী, মহারাজকুমারী গায়ত্রী দেবী ও মহারাজকুমারী মেনকা দেবী এবং যুবরাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ও মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ নামে মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের পুত্র – কন্যা ছিলেন।

মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ  প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলি

তিনি ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ইন্ডিয়া ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ বছরই জলপাইগুড়িতে মহারাজা  নৃপেন্দ্রনারায়ণ হল এবং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং শহরে জুবলি স্যানিটোরিয়ামের জন্য মহারাজা জমি এবং বাড়ি দান করেন, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করেন এবং  রাজ্যের উচ্চশিক্ষার জন্য ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভিক্টোরিয়া কলেজ স্থাপন করেন।  ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বোনের স্মৃতিকে সঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে আনন্দময়ী ধর্মশালার উদ্বোধন করেন এবং ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে নরেন্দ্রনারায়ণ পার্কের (Narendranarayan Park) উদ্বোধন করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে “লজ  নৃপেন্দ্রনারায়ণ” নামে ফ্রীম্যানশনস্ লজের একটি শাখা স্থাপন করেন । ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে কুচবিহার মিউচুয়াল ফান্ডের সূচনা হয় এবং মহারাজা ছিলেন তার পৃষ্ঠপোষক। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কোচবিহার ক্লাব স্থাপন করেন। তিনি মহারানী সুনীতি দেবীর নামে সুনীতি একাডেমী (কলেজ) ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করেন। বৈরাগী দিঘির উত্তর পাড়ে  ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান পাকা মদনমোহন মন্দির  নির্মাণ করেন এবং ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের  ৪ঠা মে মহারাজা শাস্ত্র মতে বিশেষ পূজা ও যজ্ঞের মাধ্যমে বর্তমান মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি উদ্বোধন করেন। তিনি ঐতিহাসিক ল্যান্সডাউন হলের উদ্বোধন করেন ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের  ৬ই ফেব্রুয়ারি। টিপু সুলতান মারা যাওয়ার প্রায় ১০০ বছর পরে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ব্রিটিশদের কাছ থেকে কোলকাতায় উডল্যান্ডস্ কিনে নেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন।

ভারত ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাবের সদস্য

মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব, যেমন– মারবারো, ক্যাভালরি, পোর্টল্যান্ড, প্রিন্সেস, কুইন্স, রানিলাখ, রোহ্যাম্পটন ক্লাবের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি হালিংহাম ও মেলবোন ক্রিকেট ক্লাবের সম্মানিত সদস্যভুক্ত হয়েছিলেন। ভারতের ক্লাবের মধ্যে ইউনাইটেড সার্ভিসেস ক্লাব, সিমলা, হুইলার ক্লাব, মিরাট, দ্য হিমালয়ান ক্লাব, মুসৌরি, দার্জিলিং ক্লাব, ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব, এবং ক্যালকাটা ক্রিকেট, রেকেট  এন্ড পোলো ক্লাব, দা সাটারডে ক্লাব, দা আনসেরিমোনিয়ালস্ প্রভৃতির তিনি সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

ভারতের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য ও সভাপতি

মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ কলকাতার ইন্ডিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন। লেডি ডফরিন পান্ডের তিনি ছিলেন কাউন্সিলর। পাস্তুর ইনস্টিটিউট এর সদস্য, ইন্ডিয়ান সাইন্স অ্যাসোসিয়েশন, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, বাংলা সাহিত্যসেবী প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য এবং ভারতের সংগীত সমাজের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি রয়্যাল কলোনিয়াল সোসাইটি, ইম্পেরিয়াল ইনস্টিটিউট, সোসাইটি ফর এনকারেজমেন্ট অফ ইন্ডিয়া আটর্স এবং সোসাইটি অফ আর্টস অন্ড সাইন্সের ফেলো ছিলেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে শুরু হওয়া আই এফ এ শিল্ড তৈরি করার জন্য তিনি অর্থ প্রদান করেন।

Maharaja’s Glorious Title and Honor – 

Major, 22August 1883

Colonel, A.D.C :- Aide-de-Camp, 30th July 1887

G.C.I.E :- Knight Grand Commander of the Most Eminent order of the Indian Empire, 23rd February, 1888

C.B :- Companion of the Bath, 20th May, 1898

শেষ নিঃশ্বাস

মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭ টা ২৫ মিনিটে ইংল্যান্ডের  বেক্সহিল অন-সি (Bexhill on Sea) নামক স্থানে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কর্নেল ছিলেন বলে ইংল্যান্ড সম্রাট তাঁর মরদেহ  যথোচিত মিলিটারি সম্মান সহকারে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেখানেই তার অন্তেষ্টিক্রিয়া সমাপন করা হয়। ইংল্যান্ড থেকে মহারাজের চিতাভস্ম বিশেষ ট্রেন করে রুপোর শব-ভশ্মাধারে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর সকাল ১০ টা ১২ মিনিটে কুচবিহার রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছায় এবং ওইদিনই মহারাজার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন  হয়।

Funeral of Nripendra Narayan

Funeral of the Maharaja Nripendra Narayan, 21st September 1911, Bexhill-On-Sea (Pic Courtesy Bexhill Museum)

আজ সুপরিকল্পিত রাজনগরের বড়ো দুরবস্থা। যেখানে সেখানে জায়গা দখল করে অবৈধ নির্মাণ, পরিকল্পনাহীন অট্টালিকার সারি, নগর কুচবিহারের শ্রী নষ্ট করে  দিয়েছে। অনেক দিঘি হয় বুজিয়ে ফেলা হয়েছে নতুবা চারপাশ ঘিরে দোকানপাট বা বাড়ি তৈরি হয়েছে। বড়ো কোনো অগ্নিকান্ডে জল মেলে না। হেরিটেজ শহর শুধু ঘোষণা করলেই হবে না। নগর পরিকল্পনার সুব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটাই হবে আধুনিক কুচবিহারের রূপকারের প্রতি নবপ্রজন্মের যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।


# Maharaja Nripendranarayan, Sunity Debi and Coochbehar, Coochbehar Madan Mohan temple, Pasteur Institute, Photography Club, 

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)