ত্যারেয়া বা ট্যারেয়া , কৃষিজীবী কোচ-রাজবংশী সমাজে প্রচলিত লোকাচার: মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক।

VSarkar
0
ত্যারেয়া বা ট্যারেয়া

আজ ১৩ই ফাল্গুণ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ২৬শে ফেব্রুয়ারী ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ, আমি কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ও মানুষ প্রকৃতির মধ্যেকার নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ কোচ-রাজবংশী সমাজের আর একটা কৃষিভিত্তিক লোকাচার আপনাদের সকলের সামনে তুলে ধরতে চলেছি। ইতিপূর্বে বর্ষাকালে আমার লেখা কবিতা নয়া দ্যাওয়া তে ও কিছুটা কোচরাজবংশী লোকাচার তুলে ধরেছিলাম, এরপর শরৎকালে ডাঙলক্ষ্মী বিষয়ক লেখাটিতে ও আলোচনা করেছিলাম। আজকে আলোচনা করবো ট্যারেয়া বা ত্যারেয়া বা তেরেয়া (Terea Puja) বিষয়ক।

Writer: Dipu Ray, Author/Contributor

কোচ-রাজবংশী (Koch-Rajbanshi) কৃষিভিত্তিক মানুষ ফাল্গুণের তেরো তারিখ এই লোকাচার তথা উৎসবটি পালন করে। ঐদিন গোয়ালঘরটি ভালো করে পরিস্কার করা হয়, বাড়ির মেয়ে-বউরা গোয়াল ঘর সহ বাড়ির অন্যান্য ঘর গুলো লেপে (লেপে দেওয়া:- জল, পলিমাটি বা গোবরজল দিয়ে ঘর লেপা) দ্যায়। এরপর গোবরের একটা সামান্য অংশ কলার খোলে রেখে মাদার ফুল, অন্যান্য ফুল আর ধূপ কাঠি সহযোগে তে-রাস্তা বা চৌ-রাস্তার মোড়ে সেটাকে রেখে পূজো করা হয়, সাথে জলভরা পাত্র রাখা হয় (বালতি বা গামলা বা কলসিতে জল রাখা হয়)। পূজা শেষে ওঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে মাথায় জলের পাত্রটির জল ঢেলে দিয়ে পিছনে না তাকিয়ে বাড়ি ফিরে আসা হয়। এই আচারটি বাড়ির গবাদি পশুকে যে দেখভাল করে সেই সদস্যটি কিংবা মহিলা সদস্যা কিংবা বাড়ির ক্ষুদে সদস্যরা পালন করে থাকে।

এরপর গবাদি পশুগুলিকে স্নান করানো হয়। বিশ্বাস করা হয় যে শীত বিদায় নিচ্ছে। বসন্ত কঁড়া নাড়ছে। আর আমরা সবাই জানি শীত গ্রীষ্ম কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক পরিমন্ডলের পরিবর্তন সবার প্রথমে পশু-পাখি কিট পতঙ্গই অনুভব করে। তাই আজ থেকে গবাদি পশুদের জন্য শীত বিদায় নিল। এরপর সন্ধ্যাবেলা গেরস্থ বাড়িতে আয়োজিত হয় ভূড়ি ভোজ যা ‘রাখাল সেবা’ নামে পরিচিত। কোথাও নিরামিষ বা কোথাও আমিষ খাওয়ার চল আছে।

বিশেষ উল্লেখ্য এই লোকাচারটি বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভারতের উত্তরবঙ্গ ও অসমের কোচ-রাজবংশী হিন্দু এবং কোচ-রাজবংশী মুসলিম (যারা নস্যশেখ নামে পরিচিত) উভয়ই পালন করে।

Terea puja cow bath

চিত্র: গবাদি পশুকে স্নান করানো হচ্ছে। ছবি – লেখক

এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে, আমরা সবাই জানি ২২শে ডিসেম্বর মকর সংক্রান্তি বা Winter Solstice এর দিন থেকে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয় আর ২১শে মার্চ মহাবিষুব বা Summer Equinox যেদিন পৃথিবীর সর্বত্র ১২ঘন্টা দিন ও ১২ঘন্টা রাত। এরপর উত্তরগোলার্ধে দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়।

Rituchakra terea

চিত্র: পৃথিবীতে ঋতুচক্র পরিবর্তন। ছবি – গুগল

তাই কোচ-রাজবংশী সমাজের এই লোকাচারটি মানুষ ও প্রকৃতির এক নিবিড় সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে — যেহেতু ফাল্গুনের ১৩ তারিখ এই উৎসবটি পালিত হয় তাই তেরো থেকে এর নামটি তেরেয়া বা ট্যারেয়া বা ত্যারেয়া।

তথ্যসূত্র:-

১] রাজবংশী ভাষার ইতিহাস (গ্রন্থ সংকলন)- বর্মা, দেবেন্দ্রনাথ

২] রাজবংশী সমাজের কৃষি-প্রযুক্তি (গ্রন্থ সংকলন)- বর্মন, ডঃ পরিমল

৩] উত্তরবঙ্গের ক্ষত্রিয় রাজবংশী সমাজের পূজাপার্বণ (প্রবন্ধ)- রায়, প্রসেনজিত

ব্যক্তি গত সাক্ষাৎকার :-

১] শ্রী সুশীল রায় (কোচ-রাজবংশী জাতির প্রবীন ব্যক্তি), উত্তর রাঙ্গালীবাজনা,

আলিপুরদুয়ার, তারিখ:- ২৬/০২/২০২২

২] শ্রী অসীম অধিকারি (কোচ-রাজবংশী জাতির একজন পুরোহিত তথা নাম-মন্ত্র দাতা গুরু), উত্তর রাঙ্গালীবাজনা, আলিপুরদুয়ার, তারিখ:- ২৬/০২/২০২২

🖋: দীপু রায়

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)