ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কুচবিহার রাজ্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী - জঙ্গী তকমা।

VSarkar

Historical aspects of Coochbehar State – Extremist label

Coochbehar extremist

Written by: Kumar Mridul Narayan

কুচবিহার রাজ্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী - জঙ্গী তকমা

ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। আর সেইসব ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছে কিছু রাজবংশ ও রাজবাড়ী। সেইরকম রাজবাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম কুচবিহার রাজবাড়ি (Coochbehar Palace)। যেমন তার সৌন্দর্য্য তেমনই তার ইতিহাস। রাজ আমলে রাজপ্রাসাদের  উপর এসেছিল  প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং মহারাজাদের বদান্যতায় কালক্রমে সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জেলার পরিণত হওয়ার পর রাজবাড়ীর উপর পড়েছিল কুচক্রীদের নজর। ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ। কেউ চেয়েছিল রাজবাড়ীকে পানশালায় পরিণত করতে। কেউবা চেয়েছিল  হোটেলে পরিণত করতে। চেষ্টা হয়েছিল পর্যটকদের আবাসন কেন্দ্র করার।

যথেচ্ছভাবে লুট হয়েছিল রাজবাড়ীর বহুমূল্যবান আসবাবপত্র। বেদখল হয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ীর নিজস্ব জমি। এককথায় বলা যায় রাজবাড়ীকে ব্যবসায় পরিণত করার একটা অপপ্রচেষ্টা। এটা কি রকম চিন্তাভাবনা ? যাই হোক ভালো চিন্তা করার লোকের তো অভাব নেই। অনেক আন্দোলন এবং আবেদনের পর ভারতীয় জাতীয় পুরাতত্ত্ব  বিভাগ কুচবিহার রাজবাড়িকে অধিগ্রহণ করে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ। অধিগ্রহণের পর সরকারিভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও অভিভাবকের অভাবে রাজবাড়ী জৌলুস অনেকটাই হারিয়েছে। তবুও বাবা মদনমোহনের আশীর্বাদে কুচবিহার রাজবাড়ী আমাদের সামনে মন্দির রূপে পূজিত হয়ে আসছে। সরকার চেষ্টা করলেই কুচবিহার রাজবাড়িকে আন্তর্জাতিক মানের রূপ দিতে পারতো। অতীতে কুচবিহারের সঙ্গে ভারতবর্ষ তথা আন্তর্জাতিক স্তরে সুসম্পর্ক ছিল। কুচবিহারের রাজা, মহারাজা, রাজকুমারী, রাজকুমার তার নিজ নিজ শাসন, দক্ষতা ও কৌশলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে ছাপ রেখে গিয়েছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে কুচবিহারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরে  সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল। রাজশাসন এর অবসানের পর প্রান্তিক জেলা কুচবিহার আঞ্চলিকতার যাঁতাকলে পড়ে  তার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। আধুনিকতার নতুন আঙ্গিকে এসে কুচবিহারের গৌরবময় ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের পথে অভিভাবকের অভাবে। ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ি, শপিং মহল ,সিনেমা হল যদি আধুনিকতার নিদর্শন হয় — ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি,  ধ্বংস করে  কোন জাতির উন্নতি সম্ভব নয়।

পন্ডিত ভলতেয়ার (Voltaire) বলেছেন, “অতীতের মধ্যে বর্তমান জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে এবং বর্তমান ভবিষ্যতের জনক”।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। তখন স্বাধীন কুচবিহার রাজ্যের রাজা ছিলেন মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায় ভূপবাহাদুর। এককথায় স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে কুচবিহার ছিল একটি স্বতন্ত্র রাজশাসিত রাজ্য ।সেদিন রাজশাসিত কুচবিহার রাজ্যে ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ নিজেই কুচবিহার নীলকুঠির মাঠে সকাল সাড়ে আটটায়  ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ভারতের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানান। সেখানে মিলিটারি ও পুলিশ প্যারেড ও মার্চপাস্ট হয় এবং বিরাট জনতা উপস্থিত থাকিয়া এই উৎসবে যোগ দেয়। স্বাধীন ভারতের মঙ্গল কামনায় সকল দেবালয়, মসজিদ, গির্জা ও ব্রাহ্ম মন্দির বিশেষ পূজা ও প্রার্থনা হয়। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা উপলক্ষে মহারাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ (Maharaja Jagadipendra Narayan) এর সভাপতিত্বে ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটায় সাগরদিঘির দক্ষিণ পাশে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং মহারাজা একটি সুন্দর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দান করেন। এক কথায় বলা যেতে পারে, রাজশাসিত কুচবিহার স্বাধীন ভারতের অংশীদার না হয়েও ভারতের স্বাধীনতাকে  সম্মান এবং শ্রদ্ধা  জানিয়েছেন।

স্বতন্ত্র রাজশাসিত  কুচবিহার প্রজাবৎসল রাজার হাত ধরে সুন্দর ভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু বাঁধ সাধলো একশ্রেণীর বিভেদকামী, ষড়যন্ত্রকারী, সুবিধাভোগী, মহারাজার আস্থাভাজন লোকেদের ষড়যন্ত্র এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কুচবিহার রাজপ্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্বস্ত এবং কাছের লোকদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে চিন্তিত মহারাজ নিরুপায় হয়ে প্রজাকল্যাণের স্বার্থে সর্বোপরি ভারত সরকারের অনুরোধে মার্জার এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করেন, ২৮ শে আগস্ট ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে। সেই চুক্তির ফলে কুচবিহার ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৪৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর। রাজশাসিত কুচবিহার ভারতভুক্তির পর চিফ কমিশনার এর অধীনে রাখা হয়। এটাই স্বীকৃত, এটাই বাস্তব, এটাকে কখনই অস্বীকার করা যায়না। যাবেনা।যাবেনা। এবার শুরু হল আর এক চক্রান্ত। কুচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার একটা কুচক্রীদের অপপ্রচেষ্টা এবং সেটা সফল হল। ১৯৫০ সনের ১লা জানুয়ারি ৪৫০ বছরের রাজশাসিত কুচবিহার পরবর্তীতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং শেষে পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রান্তিক জেলায় পরিণত হল।

এ ক্ষেত্রে বলে রাখি সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষ এখন পরাধীনের ইতিহাস পড়েছে আর বড় বড় ডিগ্রী লাভ করেছে। কিন্তু স্বতন্ত্রের ইতিহাস তো জানে না। এই ভারতবর্ষের বুকে কেবলমাত্র কুচবিহারের ইতিহাসেই হইল স্বাধীন ইতিহাস। কেননা সারা ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্ব ব্রিটিশের অধিনে ছিল কিন্তু কুচবিহার বিশ্বের কাছে স্বতন্ত্র ছিল।

কুচবিহারের ভারতভুক্তি তথা পশ্চিমবঙ্গের জেলায় পরিণত হওয়ায় আজ প্রায় ৭০ বছর অতিক্রান্ত। এই ৭০ বছরে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে অনেক সরকার এসেছে এবং তারা শাসন করছে বা ভবিষ্যতে তারাই শাসন করবে। দীর্ঘ এই শাসনে আমরা কি পেলাম? কিছু পাইনি বা কিছু হয়নি বলবো না, কিন্তু যতটা প্রত্যাশা ছিল তার কিন্তু অনেকটাই পূরণ হয়নি। ভারত ভুক্তির সময় যে সমস্ত  চুক্তিগুলি ছিল সেগুলো কোনটাই বাস্তবায়িত হয়নি বা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়নি। কোন যাদু বলে রাজ্য থেকে জেলায় পরিণত হলো তার সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। দীর্ঘ এই ৭০ বছরে কুচবিহার তথা কামতাপুরের (Kamtapur) ভূমিপুত্র বা অধিবাসীগণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে সরকারের (কেন্দ্র-রাজ্য ) সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে। বিগত দিনের উভয় সরকার  শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল,বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিল না। বর্তমান রাজ্য সরকার কিছু প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার খামতি ও অনেক। 

সম্প্রতি কিছু দাবি উঠেছে উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য করার। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই আলাদা রাজ্যের দাবি নয়ের দশকের শুরু করেছিল এখানকার ভূমিপুত্ররা দীর্ঘ বঞ্চনার পর। তখন তাদের বলা হয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী!  আপন জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এখানকার ভূমিপুত্রদের  জঙ্গী তকমা দেওয়া হয়েছিল। উত্তরবঙ্গ জুড়ে দাবি উঠেছিল কামতাপুর রাজ্য (Kamtapur State) প্রতিষ্ঠার। দাবি উঠেছিল কুচবিহার রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার। ভারত ভুক্তির চুক্তি মোতাবেক কি আছে সেটাও পর্যালোচনা করা। মনে রাখা প্রয়োজন, আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি উঠলে তা বিবেচনার যোগ্য। দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে সবাই চায়। নিজের অস্তিত্বকে কি কেউ কখনো ভুলতে চায় ?


Kumar Mridul Narayan – Assistant Secretary, Coochbehar Royal Family Successors Welfare Trust.