শামুক চাষ করে লাখপতি !
শামুক (Snail) বা শম্বুক হল মলাস্কা (Mollusca) পর্বের গ্যাস্ট্রোপডা Gastropoda শ্রেণীর প্রাণী। শামুক নরমদেহী এবং প্রাপ্তবয়স্ক শামুকের দেহ একটি প্যাঁচানো খোলকে আবৃত থাকে। শামুক বলতে সাধারণত স্থলচর, মিষ্টি জল ও সামুদ্রিক শামুককে বোঝায়। শামুকের অনেক নামও রয়েছে জায়গা ভেদে। বাংলা ভাষায় যেমন শামুক বলে তেমনি কামতাপুরী /রাজবংশী ভাষাত টাকোয়া, গুজুরি বলে। দক্ষিণবঙ্গের অনেক জায়গায় গুগলিও বলে। শামুকের নামে আলিপুরদুয়ার জেলায় একটি জায়গার নামই রয়েছে – শামুকতলা (Shamuktola)। আবার টাকোয়া নামেও জায়গার নাম রয়েছে কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমায় – টাকোয়ামারী (Takoamari)।
শামুকের বাসস্থান (Habitat of Snail)
শামুক স্যাঁতস্যাঁতে, ঝিল, বিল, ডোবা নালা, পুকুর, প্রভৃতি জায়গায় বসবাস করে।
শামুকের শারীরিক বৈশিষ্ট্য (Physical Characteristics of Snail)
বেশীরভাগ শামুকই এপিথেলীয় সিলিয়া দ্বারা আবৃত পিছল পায়ের সাহায্যে পিছলে চলে, এই পা মিউকাসের সাহায্যে পিচ্ছিল হয়ে থাকে। পায়ের পেশীতে পরপর ঘনঘন সঙ্কোচন ঘটিয়ে শামুক চলাচল করে। কাঁচের দেয়াল বা এ্যাকোয়ারিয়ামের দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকা শামুকের দিকে তাকালে পেশীর এই নড়াচড়া স্পষ্ট বোঝা যায়। শামুকের চলার গতি অত্যন্ত ধীরস্থীর, লুকোরাম (Helix lucorum) প্রজাতির শামুকের ক্ষেত্রে ১ মিমি/সেকেন্ড স্বাভাবিক গতি)। এজন্য একটা প্রবাদও রয়েছে। শামুকের পায়ে থাকা মিউকাস ঘর্ষণ কমিয়ে তাদের পিছলে চলাতে সাহায্য করে। এই মিউকাস ধারালো বা তীক্ষ্ণ বস্তু লেগে শামুকের দেহ কেটে যাওয়া থেকে বাঁচাতেও সাহায্য করে। এই কারণে শামুক ধারালো বস্তু যেমন ব্লেডের উপর দিয়ে চলতে পারে কিন্তু তাতে তাদের দেহ কেটে যায় না।
শামুকের খাদ্যাভাস (Food habit)
প্রকৃতিতে থাকা অবস্থায় শামুক নানা রকম খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। স্থলচর শামুকরা তৃণভোজী। এরা গাছের নরম ছাল, গাছের পাতা, ফল, শাক ইত্যাদি খেয়ে থাকে। শামুকের কিছু প্রজাতি শষ্য ও বাগানের গাছের ক্ষতিসাধন করে এই জাতের শামুককে ক্ষতিকারক কীটের দলে ফেলা যায়। আবার কিছু প্রজাতি ক্ষেতের কীট খেয়ে উপকারও করে যার জন্য Biological pest controller বলা হয়। জলজ শামুক বিভিন্ন ধরণের খাদ্য যেমন প্ল্যাংকটন, শৈবাল, ছোট ছোট গাছ গাছড়া এবং অন্যান্য জলজ আণুবীক্ষনিক জৈববস্তু খায়।
শামুকের জীবনকাল (Life span)
বিভিন্ন প্রজাতির শামুকের আয়ু বিভিন্ন। হেলিক্স প্রজাতির শামুক ২ থেকে ৩ বছর বাঁচে, আবার অ্যাকাটিনেড (Achatina) প্রজাতির শামুক ২ থেকে ৩ বছর বাঁচে। অ্যাকোয়াটিক বা জলে বসবাসকারী আপেল জাতের শামুকের আয়ু মাত্র এক বছর। বেশীরভাগ শামুকের মৃত্যু হয় শিকারী যেমন সাপ, ক্যাটফিস এর হাতে আর নয়তো পরজীবী দ্বারা। গৃহবন্দী অবস্থায় শামুকের আয়ু অনেক বেশি হয়, বেশীরভাগ প্রজাতির ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। কিছু কিছু শামুকের প্রায় ৩০ – ৩২ বছর পর্যন্তও বাঁচার নজির রয়েছে।
শামুক চাষ পদ্ধতি (Snail Cultivation)
১ একর (১ একর = ১০০ শতক, ১ বিঘা = ৩৩ শতক, ১ কাঠা = ১.৬৫ শতক, ১ বিঘা = ২০ কাঠা) পুকুরে প্রতি শতক হিসেবে এক কেজি খৈল, এক কেজি গোবর সার ও ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া জলে ভালোভাবে মেশাতে হবে। ইউরিয়া [CO(NH2)2] জলজ উদ্ভিদ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। এই মিশ্রণ সমান চারটি ভাগে ভাগ করে তিন দিন অন্তর জলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পুকুরের জলের রং যখন গাঢ় সবুজ হবে, তখন বুঝতে হবে পুকুরটি শামুক চাষের উপযোগী হয়েছে। এরপর খালবিল বা ডোবা থেকে শামুক সংগ্রহ করে প্রতি শতক হিসেবে মোটামুটি ২৪০ – ২৫০ গ্রাম শামুক পুকুরের চারদিকে ছিটিয়ে দিতে হবে। পরবর্তী ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে শামুক ব্যাপকভাবে বংশবিস্তার করবে। এরপর ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ শামুক পাওয়া যাবে। অর্থাৎ ১ একর পুকুর থেকে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে প্রায় ১৮০০-১৯০০ কেজি ছোট শামুক উৎপাদন সম্ভব। শামুকের খাবার হিসেবে প্রতি শতক হিসেবে ২৫০ গ্রাম গোবর, ২৫০ গ্রাম খৈল এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশানো কম্পোস্ট তিন দিন পরপর পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পুকুর থেকে শামুক তুলে ধানের কুড়ার সঙ্গে মিশিয়ে তাজা শামুককে প্রথমে খাদ্য ভাঙানোর পেলেট (pellet) মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়ো করা হয়। এগুলো পরে রোদে শুকানোর পর খৈল ভাঙানোর মেশিনের মাধ্যমে আবার সূক্ষ্মভাবে চূর্ণ করে সরাসরি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শামুক দিয়ে তৈরি মাছের খাদ্য লাভজনক।
শামুক যা যা কাজে লাগে (Uses of Snail)
বাড়ির আশে পাশে খাল বা ডোবায় পাওয়া যায় ছোট ছোট শামুক এখন আর ফেলনা নয়। পুকুর থেকে সংগ্রহ করা শামুক দিয়ে তৈরি হয় মাছের খাদ্য। বাণিজ্যিকভাবে শামুক চাষ করে প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। শামুকের সঙ্গে পরিমাণ মতো কুঁড়া (ধানের তুষ) মিশিয়ে মেশিনে (Milling machine) ভাঙিয়ে এ খাদ্য তৈরি করা হয়। শামুক দিয়ে তৈরি খাবার চিংড়ি, শিঙি, মাগুর, কৈ ও তেলাপিয়া মাছের খুবই পছন্দের। শামুকের তৈরি খাদ্য ব্যবহার করলে বাজারে প্রচলিত মাছের অন্যান্য খাদ্যের চেয়ে খরচ পড়ে অর্ধেক এর মতন। এ ছাড়া হাঁস মুরগি কেও নিয়মিত ভাবে শামুক খাওয়ালে হাঁস বা মুরগির মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ে। এই জন্যে মাছ, হাঁস ও মুরগির চাষ হয় অনেক লাভজনক। চুন তৈরির কাজে শামুকের খোলস ব্যবহার হওয়ার এর চাহিদাও রয়েছে। শামুক চাষে কম পুঁজি লাগে বলে এ থেকে আয়ও হয় অনেক বেশি। এই খাবারই মাছের খাবার ‘মিট অ্যান্ড বোনের’ বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আজকাল। পূর্ণাঙ্গ শামুক উৎপাদন হতে সময় লাগে ৪০ থেকে ৬০ দিন। পুকুর থেকে হেক্টরপ্রতি বছরে চারটি ধাপে চার থেকে ছয় মেট্রিক টন শামুক উৎপাদন করা সম্ভব। মাছ চাষে প্রাণিজ প্রোটিন একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। দেশীয় শামুক ব্যবহার করে মাছের খাবার তৈরি করলে একদিকে যেমন ব্যয় কম হয়, সেই সঙ্গে পুষ্টিগুণও ঠিক থাকে। শুঁটকি মাছ ব্যবহার করে মাছের খাবার তৈরি করলে অনেক সময় রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক ভাবে চাষ করা শামুকের তৈরি খাদ্যে এ আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
যারা অলরেডি মাছ চাষ করছেন বা হাঁস মুরগির খামার রয়েছে তারা পরীক্ষামূলক ভাবে শামুক চাষ শুরু করে দেখতে পারেন। আর শুরুতেই যারা শামুক চাষ করতে চান তারা শামুক বিক্রী কোথায় করবেন সেই জায়গা গুলো প্রথমে পয়েন্ট আউট করুন।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় শামুকের মাংস খাওয়ার চল আছে। ওখানকার মানুষেররা গুগলি নামে শামুক টিকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। উত্তরের বিভিন্ন জেলার মানুষেররাও শামুকের মাংস প্রাণভরে উপভোগ করে। কামতাপুরী কোচ রাজবংশী মানুষের অনেকেই এই মাংস বহুযুগ থেকে খেয়ে আসছে। আগে শামুকের মাংস খাওয়াকে অনেক মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত মানুষ অন্য নজরে দেখত। কিন্ত শামুকের বিভিন্ন গুণাবলী জানার পর এখন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়মিত রুপে শামুকের মাংস খায়। তবে সব প্রজাতির শামুক আমাদের খাবারের উপযোগী নয়। হোরপা হল শামুকের সুস্বাদু পদ যা কামতাপুরী মানুষেরা প্রাণভরে উপভোগ করে। বাঙালী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও শামুকের মাংস খাওয়ার প্রবনতা অনেকাংশে বেড়েছে। ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে লেখা স্কটল্যান্ডের এক ইতিহাস বইয়ে বিভিন্ন প্রজাতির শামুকের কথা ও তাদের বিভিন্ন উপকারীতার কথা লেখা আছে। (A history of Scotland written in the 1800s recounts a description of various snails and their use as food items in times of plague – wikipedia). ইন্দোনেশিয়ার অনেক জায়গাতে শামুক ভাজা করে খাওয়া হয় অনেকটা সিখ কাবাবের মত, তাদের এই প্রিয় ডিসের নাম “সাতে কাকুল” (Sate kakul)। আফ্রিকায় এক ধরনের বৃহদাকার স্থলচর শামুক খাবারের জন্য চাষ হয়। ফ্রেন্স কুইসিনে শামুকের বিভিন্ন পদ হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়।
শামুকের মাংসের উপকারীতা বা পুষ্টিগুণ (Benefits of Snail)
শামুকের মাংসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ১২, জিঙ্ক থাকে। তাছাড়াও পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, সেলেনিয়াম ও আয়রন যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় শামুকের মাংশে। সবচেয়ে পুষ্টিকর, সহজলভ্য ও সস্তার মাংস হল শামুকের মাংশ। যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষের সময় শামুকের মাংস ব্যবহার হত (see Famine Food)।
বর্ষাকালে ধান ক্ষেত বা বিলের মধ্যে গোলাকার শামুক (আপেল শামুক), ছোটো লম্বা ছুচালো আকৃতির শামুকের বিভিন্ন পদ সাধারনত আজকাল বিভিন্ন হোটেলেও পাওয়া যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে শামুকের মাংসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শামুকের মাংস প্রোসেসড, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার সুযোগ অদূর ভবিষ্যতে আসতেই পারে। আর তা যদি হয় তাহলে লোকাল বাজার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারেও শামুকের মাংস রপ্তানি করে ইনকাম কয়েক গুন বাড়ানো যেতে পারে (Export Data)।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ যদি শামুক চাষ করেন বা বিক্রি করেন তাহলে নিচের কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। অর্গানাইজড ভাবে শামুক চাষের এবং বিভিন্ন বাজারে দৈনিক কত পরিমাণ শামুকের কেনাবেচা চলে (roughly হলেও চলবে) এব্যাপারে কোনো তথ্য যদি থাকে তাহলে নিচের Leave a Reply বা কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।
আরো বিস্তারিত ভাবে যদি কেউ জানতে চান তাহলে নিচের লিঙ্ক গুলোতে যোগাযোগ করতে পারেন –
Satmile Satish Club, Coochbehar
Fishery Faculty, WUAFSCS – Kolkata
বাংলাদেশে কেউ যদি শামুক কিনতে চান তাহলে নিচের লিঙ্ক এ যোগাযোগ করুন – Arman Hossain (Rangpur), Hafiz Ahmed (Natore)
Continue Reading..
অপকারী শামুক (Harmful Snail)
শামুক শুধু উপকারই করেনা, শামুকের অনেক প্রজাতি আমাদের ক্ষতিও করে। শামুক তার শরীরে বিভিন্ন ক্ষতিকর পরজিবী বহন করে যা সংস্পর্শে আসলে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। শামুক বাহিত বিভিন্ন রোগ হল schistosomiasis, angiostrongyliasis, fasciolopsiasis, opisthorchiasis, fascioliasis, paragonimiasis (source – wikipedia)
ঘরের ভিতরে স্থল শামুকের অযাচিত প্রবেশ থেকে রেহাই
বাড়ির দেয়ালে স্থলচর শামুক উঠলে অনেকেরই বিরক্তি প্রকাশ হয়। অনেকে সময় মেঝে ও দেয়াল বেয়ে ঘরের ভিতরেও প্রবেশ করে। ঘরের ভিতরে শামুকের অযাচিত প্রবেশ থেকে রক্ষা পেতে হলে যা যা করবেন।
ডিমের খোসা পুরোপুরি গুঁড়ো না করে ছোটো ছোটো করে টুকরো করে ভেঙে শামুকের চলার পথে ফেলে দিন।
ডিমের খোসা
শামুক সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা পছন্দ করে, তাই মাটি সর্বদা শুকনো রাখার চেষ্টা করুন।
বিকেলে না দিয়ে সকালে গাছে জল দিলে শামুকের সমস্যা অনেক টা কমে যায়।
গাছের নিচে মরা পাতা আর আগাছা থাকলে তা তুলে ফেলুন, এরা ডাইরেক্ট সূর্যের আলো পছন্দ করেনা তাই পাতা বা আগাছার নিচে থাকার সম্ভাবনা কম
মাটির নিচে শামুকের ডিম থাকে তাই মাঝে মাঝে মাটি খুচিয়ে ডিম নষ্ট করে দিন। কাটা ফল যেমন পেপে, শশা টোপ হিসেবে ব্যবহার করেও দমন করতে পারেন।