কুচবিহার রাজকুমারদের কথা (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
লিখেছেন – কুমার মৃদুল নারায়ণ
মহারাজকুমার গৌতম নারায়ণ / Rajkumar Gautam Narayan
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের পৌত্র এবং মহারাজকুমার ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্র রাজকুমার গৌতম নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায় ১৯১৮খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে। ছোট ছেলে গৌতম নারায়ণকে অল্প বয়সেই লেখাপড়ার জন্য বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডে পাঠ্যকালে ট্রিনিটি কলেজের ক্রিকেট টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন (সূত্র – কুচবিহার দর্পণ )। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই নভেম্বর । এই সময়ে তিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হয়ে বোম্বে স্যাপারস্ এন্ড মাইনার্সের সাথে যুক্ত হন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১লা অক্টোবর। পরবর্তীতে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন পদে এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর মেজর পদে উন্নীত হন।
গৌতম নারায়ণের কর্মজীবন ও বিবাহ
মহারাজকুমার গৌতম নারায়ণ কুচবিহার রাজ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের পার্শ্বচর হিসেবে এডিকং পদে নিযুক্ত হন। মহারাজা তার খুড়তুতো ভাই গৌতম নারায়ণকে রাজ্য পরিদর্শনে সফরসঙ্গী করতেন। তিনি ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুচবিহার রাজ্যের পূর্ত বিভাগের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কুচবিহার সাহিত্য সভার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হয়েছিলেন। জিমখানা ক্লাবের সদস্য পদে দীর্ঘদিন আসীন ছিলেন। এছাড়াও তিনি কলকাতার উইলিয়াম জ্যাকস কোম্পানির ডিরেক্টর, দি ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, কলকাতা টার্ফ ক্লাব এবং স্যাটারডে ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি “দি ক্যালকাটা র্যাকেট ক্লাব” এর প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। “রাজকুমার গৌতম নারায়ণ ট্রফি” নামে একটি ট্রফি এখনও প্রচলিত আছে ওই ক্লাবে।
রাজকুমার গৌতম নারায়ণ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বিদেশিনী প্যাট্রিসিয়া জোয়ান কুইনকে বিবাহ করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের দুটি কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম কন্যা ভিক্টোরিয়া পিয়া নারায়ণ এবং দ্বিতীয় কন্যা দীপা এলিজাবেথ নারায়ণ। পিয়া নারায়ণ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২১শে মার্চ।এলিজাবেথ নারায়ণ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তারা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। মহারাজকুমার গৌতম নারায়ণ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ / Rajkumar Indrajitendra Narayan
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ এবং মহারানী ইন্দিরা দেবীর দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠপুত্র মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুলাই পুনায় জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় রাজকুমারের জন্মের পর মহারাজা যথাসময়ে সাড়ম্বরে শুভ অন্নপ্রাশন এবং নামকরণ করেন। ছোটবেলায় রাজবাড়ীতে ভাই-বোনেরা হইহুল্লোড় করে মাতিয়ে রাখতেন। বিভিন্ন গৃহশিক্ষকের কাছে রাজকুমারের প্রাথমিক শিক্ষালাভ আরম্ভ হয় রাজবাড়ীতে। পরবর্তীতে তিনি একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা করেন। আজমীরের মেয়ো কলেজে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে দেরাদুনের সামরিক বিভাগ থেকে শিক্ষিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চপদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি দেশ-বিদেশের বহু স্থানে গিয়েছেন। কুচবিহার রাজ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারি ল্যান্সডাউন হলে মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের উপস্থিতিতে সাহিত্য সভার এক বিশেষ অধিবেশনে মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ কে কুচবিহার “সাহিত্য সভার” সভাপতি পদে বরণ করা হয়। তিনি এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানের ১৯৩৯ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ রাজ সরকারের জেনারেল সেক্রেটরিয়েটে সেক্রেটারী টু দি গভমেন্ট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ তার ভাই ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হওয়ার জন্য তাকে রাজ্যের উন্নয়ন বিভাগের ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট কমিশনার নিযুক্ত করেন ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই মার্চ। সর্বোপরি বলা যেতে পারে কুচবিহার রাজ প্রশাসনিক বিভাগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
প্রজাবৎসল মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভাই মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণকে খুব স্নেহ করতেন। মহারাজার শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, গ্রামের চাষাবাদ ও প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শোনার যখন প্রত্যহ ঘুরতেন এবং মহারাজকুমার ইন্দ্রজিৎ তার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকতেন। মহারাজের শিকারের সঙ্গী হতেন। তিনিও প্রজাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। মহারাজা এবং সম্মানীয় অতিথিদের নামে যেমন শিকার যাত্রা হতো, ঠিক তেমনি মহারাজকুমারদের নামেও শিকার যাত্রা হত। মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ শিকারে পারদর্শী ছিলেন।
কুচবিহার নীলকুঠি মাঠ সংলগ্ন নীলকুঠি আবাস ১৮৯১-৯২ সালে রাজ্যের সুপারেন্টেন্ড অফ স্টেট এর আবাসটি নির্মাণ করা হয়েছিল) যা নীলকুঠি রাজবাড়ী নামে পরিচিত ছিল। মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ এই রাজবাড়ীতে থাকতেন। রাজকুমারী গায়ত্রী দেবী, রাজকুমারী মেনকা দেবীকে বিবাহ করতে এসে জয়পুরের মহারাজা সওয়াই মান সিং এবং দেওয়াস রাজ্যের ক্যাপ্টেন (জুনিয়ার) শ্রীমান যশবন্ত রাও পাওয়ার বরযাত্রীসহ এই নীলকুঠি রাজবাড়িতে এসে উঠেছিলেন।
ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণের বিবাহ
মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মাদ্রাজের পিঠাপুরমের সূর্যবংশীয় মহারাজা রাজাসাহেব রাজারাও ভেঙ্কটকুমার মহীপতি সূর্যরাও বাহাদুর গারু ও তাঁর স্ত্রী রানী চিন্নামাম্বা দেবীর চতুর্থ কন্যা মহারাজকুমারী কমলা দেবীকে বিবাহ করেন। ৫ই মার্চ ১৯৪১ তারিখে নবদম্পতি কুচবিহারে শুভাগমন করেন। ওই দিন থেকেই রাজধানীতে নানা রকম আনন্দ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। রাজ্যের অধিবাসীগণ আনন্দে অধীর হয়ে নবদম্পতির শুভাগমন দর্শনের জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। রাজধানী শহরের বিভিন্ন রাস্তায় তোরণ, সদৃশ্য পতাকা পত্রে, চিত্রে সুশোভিত ছিল। নীলকুঠির ১নং ভবনে বর কনে থাকার ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যা ৭টায় সার্কিট হাউস থেকে রাজপ্রসাদ অভিমুখে বর কন্যার শোভাযাত্রা শুরু হয়। মিলিটারি, পুলিশ, সৈন্যগণ সামনের সারিতে অগ্রসর হয়েছিল, তালে তালে সামঞ্জস্য ভাবে সজ্জিত হস্তিযূথ, বর কন্যা মাল্যখচিত সুদৃশ্য মোটরগাড়ি সেই পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছিল। সাগরদিঘির দক্ষিণ পূর্বকোণে মহারাজকুমার হাতির সামনে উপস্থিত হওয়া মাত্র হাতি তাকে শুড় উঠিয়ে নতি জ্ঞাপন করে।ওই স্থান থেকে শোভাযাত্রা সিংহদ্বার অতিক্রম করে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়।
জয়পুরের মহারানী গায়ত্রী দেবী রাজপ্রাসাদে ভাতৃবধূবরণ করেন। মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হয়। ওই রাতেই রাজগন মহিলা এবং বিশিষ্ট অতিথিদের ভোজ এবং অন্যান্য উপস্থিত মহিলাদের জলযোগ, আপ্যায়ন এবং ভিন্নভাবে চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা হয়। এই অনুষ্ঠানে জয়পুরের মহারাজ সহ বহু বিশিষ্টজন উপস্থিত ছিলেন।
মহারাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ এবং রাণী কমলাদেবীর এক ছেলে এবং এক মেয়ে। জ্যেষ্ঠা কন্যা রাজকুমারী উত্তরা দেবী কুচবিহার রাজপ্রাসাদের জন্মগ্রহণ করেন ও রাজস্থানের কোটায় তার বিবাহ হয় এবং পুত্র রাজকুমার বিরাজেন্দ্রনারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর।
রানী কমলাদেবী খুব শান্ত স্বভাবের ছিলেন। রাজপ্রাসাদের বাইরে খুব একটা তিনি আসতেন না। ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ দার্জিলিঙে বসবাসকালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যান ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। এই দুঃসংবাদে কুচবিহারের জনগণ দুঃখে হতবাক হয়ে যায়। তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এখানকার দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়।
কুচবিহারের মহারাজারা যেমন প্রজাবৎসল হিসেবে বন্দিত এবং শ্রদ্ধাশীল তেমনি রাজকুমারগণও সর্বজন পূজ্য ছিলেন ।রাজশাসন চলে যাওয়ার পর কুচবিহারবাসী রাজকুমারদেরও ভুলে গেছে। এটাই কি তাদের প্রাপ্য ছিল? পন্ডিত ভলটেয়ার এর মতে, “অতীতের মধ্যে বর্তমান জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে এবং বর্তমানই ভবিষ্যতের জনক, ইহার পূর্বাপর সম্পর্কের কখনো অন্যথা হয় না”
তথ্যসূত্র :- বিভিন্ন পত্রিকা, কোচবিহার বৃত্তান্ত, রাজ্য কুচবিহারের রাজকাহিনী।
# Victor Piya Narayan, Dipa Narayan Elijabeth, The Calcutta Racket Club, Rajkumar Gautam Narayan Trophy, Rajkumar Indrajitendra Narayan, Rajkumar Gautam Narayan, Rani Kamala Debi, Nilkuthi Palace, marriage of Gayatri Debi