লিখেছেন: কুমার মৃদুল নারায়ণ
কুচবিহার ল্যান্সডাউন হল এর ইতিহাস
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ শত বছরের কোচ রাজত্বে স্থাপত্যকলার নিদর্শন রূপে কুচবিহার সমগ্র ভারতে অনন্যতার দাবী রাখে। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে পুরাতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি দেখি, কুচবিহার যে খুব সমৃদ্ধ এ বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, একদা এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য আজও সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংগ্রহশালা গড়ে ওঠেনি। নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য, সরকারি ভবন ইত্যাদি নির্মাণ ক্ষেত্রে কোচ রাজাদের অবদান উন্নত শিল্পরুচির পরিচায়ক। কোচ রাজারা সমসাময়িককালে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পী দ্বারা এইসব নির্মাণ কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও দক্ষ কারিগর সংগ্রহ করে তাদের নিয়োগ করার নজির আছে। আর এই স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হল ল্যান্সডাউন হল।
ল্যান্সডাউন হল ও মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমল থেকেই কুচবিহার রাজ্যের বিভিন্ন পরিকাঠামোয় আধুনিকতার স্পষ্ট রূপ লক্ষ্য করা যায়। তার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে, কুচবিহার তৎকালে একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং প্রজাহিতৈষী। রাজ্য তথা প্রজাপুঞ্জের উন্নতি সাধনে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন, বিভিন্ন কর্ম ও চিন্তায় তার প্রমাণ মেলে। তার এই দূরদর্শিতার ফলে নির্মিত হয়েছিল শতাধিক বৎসরের প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ ল্যান্সডাউন হল। তৎকালীন সুপারেন্টেন্ড অফ ওয়ার্কস বাবু কেদারনাথ মজুমদার এই ভবনের নকশা তৈরি করেন।
কুচবিহারের স্থায়ীভাবে পাবলিক লাইব্রেরী নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থানের প্রয়োজন ছিল দীর্ঘদিন ধরে। মহারাজা চেয়েছিলেন’ লাইব্রেরীটি এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন যাতে সরকারি সভা-সমিতি অনুষ্ঠান সেখান হতে পারে। আজ থেকে ১২৫ বছর পূর্বে তিনি জনসাধারণের জন্য এইরূপ স্থায়ী কক্ষ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন এ কথা ভাবলে অবাক হতে হয়।
বর্তমানে কুচবিহার জেলার রাইটার্স বিল্ডিং হল ল্যান্সডাউন হল। সাগরদিঘির পশ্চিম দিকে এই ভবনটি বর্তমানে জেলা শাসকের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শতাধিক বর্ষের ঐতিহ্যবাহী ভবনটি আজ আমাদের কাছে গর্বের হলেও পূর্বের অলংকরণ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। ভবনের সামনে ফুলের বাগান আজ শুধু স্মৃতি বহন করে।আধুনিক কুচবিহারের রুপকার মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমন্ত্রণে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ল্যান্সডাউন কুচবিহারের রাজ্য পরিদর্শনে আসেন। তার সম্মানার্থে মহারাজা উক্ত হল নির্মাণের প্রস্তাব জানিয়ে ভাইসরয়কে ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপনের জন্য অনুরোধ জানান। স্বাভাবিকভাবে, ভাইসরয় সম্মতি জানান এবং ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৩ এ স্ব-নামাঙ্কিত হলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর প্রায় তিন বছর ধরে হলটির নির্মাণকার্য চলে এবং ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে সম্পূর্ণ হয়। আনুমানিক ব্যয় ৬৭ হাজার টাকা। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ফেব্রুয়ারি মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন ঐতিহাসিক এই হলটির উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে ল্যান্সডাউন হলের বহির্দেশ বেশ সুন্দরভাবে সাজানো হয়। উক্ত মঞ্চের উপর নির্দিষ্ট ছিল মহারাজার জন্য স্বর্ণখচিত আসন। শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজরক্ষীগণ- বর্শা হস্তে সুসজ্জিত পোশাকে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দকে অভিবাদনে রত ছিলেন।
ঐদিন শীতের সকালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন সকাল ন’টায় রাজপ্রাসাদ থেকে ল্যান্সডাউন হলের অনুষ্ঠানস্থলে এসে উপস্থিত হন এবং প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী সৈন্যগণ দ্বারা Gourd of Honour গ্রহণ করেন। সাগরদিঘির পাশেই শান্ত ও মনোরম পরিবেশে অনুষ্ঠানের সূচনায় তৎকালীন রাজ্য -অধীকক্ষ Mr. E. E. Lowis বিশদভাবে ল্যান্সডাউন হলে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন এবং ল্যান্সডাউন হল স্থাপনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস অতিথিবৃন্দের কাছে তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে এই ভবনের মাধ্যমে প্রজাদের কি কি উপকার হবে সেটাও তিনি বিশ্লেষণ করেন।
মহারাজা তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন যে, এই ভবনটি সর্বসাধারণের জন্য তৈরি করা হলেও কোনরূপ সমাজতান্ত্রিক অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোন সভা এখানে করা যাবে না এবং রাজ্যের জনগণ এ বিষয়ে তার সঙ্গে একমত হবেন। উপরোক্ত ভাষণ থেকে মহারাজার দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। ভাষণ সমাপ্ত করে মহারাজা রুপার চাবি ধারা হলে দ্বারোদ্ঘাটন করেন এবং জনসাধারণের জন্য ল্যান্সডাউন হল উদ্বোধন করা হলো এ কথা ঘোষণা করেন। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও সংগীতের আয়োজনে ছিল। মহারানী সুনীতি দেবী, সাবিত্রী দেবী ও রাজপন্ডিত বিদ্যাবাগীশ উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এই ল্যান্সডাউন হলের প্রথম পরিচালক সমিতি নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়-
- প্রিয়নাথ দত্ত, সভাপতি
- কুমার গজেন্দ্রনারায়ান (ছোট) সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ, সদস্য
- কেদারনাথ মজুমদার, সদস্য
- মহেশ চন্দ্র সেন, সদস্য
কি কি কাজে এই হল ব্যবহার করা যাবে তারও একটি নির্দেশাবলী মহারাজা প্রকাশ করেন-
- বিশ্ববিদ্যালয় অথবা যেকোন পরীক্ষা, পুরস্কার বিতরণী অথবা রাজ্য সরকারের যে কোন কাজ।
- রাজনৈতিক ভাবনা ব্যতিরকে সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
- জনসভা – তার মধ্যে সান্ধ্যসভা ,আলোচনা ইত্যাদি।
- আনন্দ অনুষ্ঠান – অপেশাদার শৌখিন থিয়েটার, সঙ্গীতানুষ্ঠান অথবা অনুরূপ চিত্ত বিনোদনমূলক সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
পরবর্তীকালে রাজকার্য পরিচালনা সর্বোচ্চ সংস্থা রিজেন্সি কাউন্সিলের সভার জন্য এই হলকে বেছে নেওয়া হয়। এরপর ১৯৪৫ এ কুচবিহার রাজ্য সরকারের কয়েকটি দপ্তর এখানে স্থানান্তরিত করা হয়। ভারতভুক্তি থেকে জেলায় রূপান্তরিত হয়ে শতবর্ষের এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি কুচবিহার জেলা শাসকের করণ (অফিস) রূপে চিহ্নিত। সেই থেকে ক্রমশ ধূলি-ধূসরতায় মিশে যাচ্ছে তার অতীত ইতিহাস এবং আসল পরিচয়। কুচবিহারের অতীত ইতিহাসের অনেক কথাই এই ভবনকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। পুরনো ফাইলের পাতায় পাতায় রয়েছে অনেক অজানা ইতিহাসের মূল্যবান সম্পদ। অবহেলায় যাতে সেগুলি নষ্ট না হয়ে যায় তার দেখার দায়িত্ব আমাদের। সম্প্রতি শতাধিক বৎসর প্রাচীন এই ল্যান্সডাউন হল হেরিটেজ বিল্ডিং (Heritage building) রূপে ঘোষিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র :- বিশ্বনাথ দাসের কুচবিহারের পুরাকীর্তি ও ডক্টর নৃপেন্দ্রনাথ পালের ইতিকথায় কোচবিহার।