"বাগডোগরা" (Bagdogra) নামের উৎপত্তির বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং অনেকেই এর ইতিহাস সম্পর্কে পরিচিত হয়েছে। তবু পুনরায় এখানে একটু নাম প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করছি। প্রকৃত "বাঘডুকরা" (Baghdukra) শব্দটি লোক মুখে উচ্চারণ বিকৃতি হয়ে "বাগডোগরা" নাম হয়েছে। ঘন জঙ্গলে পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলটিতে এক সময় অজস্র বাঘের আবাসস্থল ছিল। আর এই জঙ্গলের পাশ্ববর্তী অঞ্চলে ছিল রাজবংশী মানুষের বসবাস। ঘন জঙ্গল ঘেরা জায়গাটিতে বাঘেদের অনবরত "ডিকিরন" শুনে রাজবংশী সমাজের মানুষ নাম রাখে "বাঘ ডুকরা"। এই "ডিকিরন" বা "ডুকরা" শব্দটি কামতাপুরী বা রাজবংশী শব্দ,যার অর্থ "গর্জন" বা "চিৎকার" করা।
ক্রমে জঙ্গল কেটে নগর স্থাপিত হতে থাকে, বাঘের সংখ্যা কমতে থাকে। চা বাগান স্থাপিত হতে থাকে,সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট স্থাপিত হতে থাকে, বিমান বন্দর স্থাপিত হয়, চাকরি-ব্যবসা এবং অন্যান্য সূএে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের আগমন ঘটে "বাঘডুকরা" অঞ্চলে। রাজবংশী মানুষের মুখে উচ্চারিত গুরুগম্ভীর "বাঘ + ডুকরা" " বাঘডুকরা" শব্দটি ক্রমে ক্রমে কোমল, অর্থহীন "বাগডোগরা" শব্দে পরিনত হয়। যে শব্দে বাঘ নেই এবং "ডোগরা" বা গর্জন নেই।
এবার আসা যাক সর্বএ আলোচিত বাগডোগরা বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাগডোগরা বিমান বন্দরের নামকরনের ক্ষেত্রে একাধিক নাম উপস্থাপন করেছেন। "সেই সব" নাম রাখার বিষয়ে এক এক জন এক এক রকমের যুক্তি তুলে ধরেছেন। বাগডোগরা বিমানবন্দর দেশের নিরাপত্তাজনিত দিক দিয়ে,পাশ্ববর্তী বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার দিক দিয়ে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
দেশ এবং দেশবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাগডোগরা বিমানবন্দর স্থাপিত করার জন্য প্রথম এবং প্রধান প্রয়োজন ছিল সুবৃহৎ পরিমাণ "জমি"। আর এই বিমানবন্দর স্থাপন করার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় স্থানীয় রাজবংশী মানুষদের কাছ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাগডোগরা বিমান বন্দর স্থাপন হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি জমি গেছে কালু রায় চৌধুরী নামক এক রাজবংশী জমিদারের। আরো কিছু নাম সংগ্ৰহ করলাম,যাদের জমির উপর বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠিত:-
০১.প্রফুল্ল সিংহ
০২.সূর্যমনি সিংহ
০৩.ভূপেন সিংহ
০৪.কলিন সিংহ
০৫.হরেন সিংহ
০৬.কর্ণস্বরী সিংহ
০৭.খলিমোহন সিংহ
০৮.মুকুন রায়
০৯.নিরেন রায়
১০.সরেন রায়
১১.নরেশ্বর রায়
১২.অনিল রায়
১৩.সুনিল রায়
১৪.তামা রায়
১৫.ঘৃতলাল রায়
এছাড়া আরো অনেক স্থানীয় রাজবংশী মানুষের জমি গেছে,যারা আর বেঁচে নেই এবং তাদের নাম ও মিশে গেছে বাতাসে। বিমানবন্দরের যখনি জমির প্রয়োজন হয়, তখনি পাশ্ববর্তী চন্ডালজোত, বৈরাগিনী, বোম ডাঙ্গি, বাওকালি প্রভৃতি গ্ৰামের রাজবংশী এবং আদিবাসী অধ্যুষিত গ্ৰামের মানুষের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বিমানবন্দরের ক্রমাগত আয়তন বৃদ্ধির কারনে পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে স্থানান্তরিত হয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। বছর কয়েক আগে বাওকালি গ্ৰামের মানুষের শ্রদ্ধা- ভক্তির "বাও কালি মাও" মন্দির ও চলে গেছে বিমান বন্দরের অধিগ্রহণে। ( "বাও" একটি কামতাপুরী শব্দ, যার অর্থ "বাতাস")।
বস্তুত বিমানবন্দরের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় অনেক রাজবংশী মানুষের মূল্যবান জমির উপর(কিছু সংখ্যক আদিবাসী মানুষের জমির উপর)। "বাগডোগরা" নামটি দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর "বাঘডুকরা" নামের উপর। এর পর যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (যদি) বিমানবন্দর নাম নির্ধারণ( পরিবর্তন)করবে তারা অবশ্যই এই অঞ্চলের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে নাম নির্বাচন করবে!!
(বি:দ্র:- এখানে সামান্য কিছু সংখ্যক জমিদাতার নাম তুলে ধরা হয়েছে। এই তালিকার বাইরে একাধিক নাম থাকা বাঞ্ছনীয়)