বড় অষ্টমীর মেলা, নাটাবাড়ি। Astami Mela Natabari

VSarkar
0
Astami mela natabari

নাটাবাড়ি পানিশালা ও চালনীরপাক গদাধরের অষ্টমীর স্নানমেলা বা বড় অষ্টমীর মেলা।

Writer: Kumar Mridul Narayan

মহাঅষ্টমী তিথিতে নাটাবাড়ি এলাকার পানিশালা গ্রামে গদাধরের অষ্টমীর স্নানমেলা বা বড় অষ্টমীর মেলা (Astami Mela Natabari) হয়। কুচবিহার সদর মহকুমার আমবাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কালজানি নদীতে চালনীরপাক (Chalanirpak – See on GMap) অংশে গদাধর মিশে গেছে। এই মিলন স্থানটি গদাধরের স্নানমেলা নামে পরিচিত। পূর্বে এই এলাকাটি জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ ছিল। গদাধরের নিজস্ব স্রোতস্বিনী ধারা ছিল। এই পূর্ণ ধারায় চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে পুণ্যার্থীরা শ্রদ্ধা নিবেদন, অস্থি ক্ষেপন  ও স্নান করতো। নদী ভাঙ্গনের ফলে পূর্বের স্রোতধারাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে চালনীরপাক শীর্ন ধারায় এই পুণ্যস্নান হয়। গদাধরের (Gadadhar River) পবিত্র জল কালজানির জলের সঙ্গে মিশে পূন্য হয়।

 এই মেলার সূচনালগ্ন কবে থেকে  সঠিক তারিখ জানা না গেলেও  প্রাচীনত্ব ও সংস্কৃতির বিচারে অষ্টমীর স্নান মেলা শুরু হয়েছিল ৭০০/৮০০ বছর আগে (সূত্র :-পশ্চিমবঙ্গের পূজো ও পার্বণ মেলা, কুচবিহার অংশ )। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের  Administrative Report এ এই মেলার কথা উল্লেখ করা আছে। ১৮৮৫-৮৬ বার্ষিক রিপোর্ট এই স্নানমেলা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ আছে যে, সংস্কৃতি সম্পদ সমৃদ্ধে ভরপুর এই স্নানমেলা এই অঞ্চলের  সবথেকে প্রাচীন। ঐতিহাসিক এই প্রাচীন মেলা এই অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। কুচবিহার আর্কাইভের সভাপতি Rzishikalpa Paul  এর মতে,” ঐতিহাসিক নথি অনুসারে এই মেলাটি কুচবিহারের সবথেকে পুরোনো মেলা”। এই গদাধরের পবিত্র জল কুচবিহার রাজ অন্তঃপুরে ও নিয়ে আসা  হয়েছিল।

Baba gadadhar natabari

Baba Gadadhar

এই স্নান মেলার তিথিকে বলা হয় অশোকাষ্টমী।এই তিথিতে পুণ্যার্থীরা এখানে স্নান করতে আসে পূণ্যতা লাভের জন্য। এই অষ্টমী তিথিতে দরিয়া বালাইতে বলরাম ঠাকুরেও স্নান মেলা , ভাটিবাড়িতে অষ্টমী স্নান মেলা, ধুবরীর ন্যাতাপোতা ঘাট, ও উত্তর প্রান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে অষ্টমীর  স্নানমেলা হয়। প্রাচীন এই গদাধরের স্নান মেলা উপলক্ষে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। পূর্বে লোকজন দলে দলে এখানে আসতো আগের রাতে। তাঁবু খাটিয়ে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থেকে পরেরদিন ভোর বেলায়  স্নান করতো। তখন যাতায়াতের জন্য গাড়ির প্রচলন না থাকায়  গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি ব্যবহার করত। তিন চার দিনের মেলা উপলক্ষে প্রচুর দোকানপাট আসতো। অনেক পুণ্যার্থী মানত উপলক্ষে কবুতর, হাঁস, ছাগল নিয়ে আসতো। এলাকার বয়স্ক লোকেরা জানান,মানত কারীদের পশুগুলি অনেক সময় ছিনতাই করে নিত ডাকাতেরা। এমনকি যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা /পাইকাররা এই পশুগুলি ক্রয় করে নিয়ে যেত তারাও ছিনতাইবাজদের হাতে আক্রান্ত হত। যাইহোক বর্তমান আধুনিক সময়ে অনেক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট হয়েছে, যানবাহন হয়েছে , দোকানপাটের ও পরিবর্তন হয়েছে। পূর্বে নদী পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকোর উপর নির্ভর করতে হতো এবং সেতু নির্মাণ হওয়ার ফলে যোগাযোগের পথ সুগম হয়েছে।

বড় অষ্টমীর মেলা – বিশেষত্ব

প্রাচীন এইমেলার বিশেষত্ব হল কাদা জলে নুন ছিটানো। ভক্তবৃন্দ তাদের পূর্ণতা লাভের আশায় এখানে লবণ ছিটায়। ভাবতে অবাক লাগলেও দেবতাকে লবণ দিয়ে মনস্কামনা পূরণ করা আজ আধুনিক যুগে মনে হয় বেমানান। এছাড়াও এখানে বিশেষ করে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষজন স্বর্গীয় পিতৃপুরুষের সর্ব লাভের জন্য সংরক্ষিত অস্থি গদাধরের জলে নিক্ষেপ করেন। নাপিত দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে মস্তক মুণ্ডন করেন অনেকে। ফুল ,জল, বাতাসা দিয়ে তুলসি গাছে পূজা দেয় বাবা গদাধরের (Baba Gadadhar) উদ্দেশ্যে। হাতে গুয়া পান নিয়ে জলে ডুব দিয়ে সখা সখি পাতানো হয়। দই, চিড়া, মিষ্টি, গুড় দিয়ে দূরদূরান্ত থেকে আগত লোকজন খাওয়া-দাওয়ার সারেন। অনেক সাধু সন্ন্যাসীর আগমনে হয় এই মেলায়। চিরাচরিত প্রথা মেনেই এভাবেই চলে আসছে গদাধরের অষ্টমী স্নানমেলা। মেলার দিন সারারাত ধরে মূল মন্দিরের চত্বরে দোতরা, কুশান, পদাবলী, কবিগান, বাউল ইত্যাদি হয়। এই মেলার অঙ্গ হিসেবে কালজানি নদীর পাশে যে মেলা বসে সেখানে আছে মা মহামায়া মন্দির।

বাবা গদাধর চালানীর পাক
চালনীরপাক গদাধরের অষ্টমীর স্নানমেলা

এই স্নানমেলা উপলক্ষে তিন চারদিন ব্যাপী বিরাট মেলা হয় আমবাড়ী এলাকায়। প্রচুর লোকসমাগম হয় এই মেলায়। বিভিন্ন রকম কেনাকাটার দোকান, খাওয়া-দাওয়ার দোকান, নাগরদোলা, লটারি, চিত্রাহার আসে পার্শ্ববর্তী জেলা এবং রাজ্যগুলি থেকে। মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধানে চলে এই মেলা। এক সময় এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল জুয়া।

১৯৩৯খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর আইন প্রণয়ন করে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন। পুরনো সংস্কৃতির পীঠস্থান এই অষ্টমীর মেলা আজ ও সকলের কাছে সমাদৃত।

প্রকাশিত লেখার একটি অংশ :-কুচবিহার রাজবংশের জ্ঞাতি জায়গির চিলাখানার সাহেববাড়ির রাজগণ বৃত্তান্ত।

কুচবিহার রাজবংশের জ্ঞাতি

প্রকাশক :-পাইকান পাবলিকেশন  

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)