কুচবিহার মার্জার এগ্রিমেন্ট। Coochbehar Merger Agreement.

VSarkar
0
কুচবিহার মার্জার এগ্রিমেন্ট

ঐতিহাসিক ভারতভুক্তির চুক্তি ২৮শে আগস্ট ১৯৪৯ [ কুচবিহার মার্জার এগ্রিমেন্ট ]

Writer: Kumar Mridul Narayan

২৮শে আগষ্ট কুচবিহার বাসির এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে ১৯৪৯ সালে Coochbehar Merger Agreement  [কুচবিহার মার্জার এগ্রিমেন্ট] স্বাক্ষরিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে আগস্ট মহারাজা জগদ্দিপেন্দ্র নারায়ণ ভারতভুক্তির ৯টি ধারা বিশিষ্ট ১৬ পৃষ্ঠার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ  এবং ভারতের গভর্নর জেনারেলের  মধ্যে যে Merger Agreement (অন্তর্ভুক্তি চুক্তি) স্বাক্ষরিত হয়, ভারতভুক্তির ৯টি আর্টিকেলের ধারাগুলি হলো –

ধারা নং – ১

কুচবিহারের মহামান্য মহারাজা তার কুচবিহার রাজ্যকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করলেন এবং এই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রাজ্য শাসনের নিমিত্ত শাসন সংক্রান্ত তার পূর্ণ এবং সকল শাসনাধিকার, আইন প্রণয়ণ অধিকার ও ক্ষমতা ভারত সরকারের কাছে অর্পণ করলেন এবং ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ সালে রাজ্যের শাসনভার ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেবেন। উক্ত দিবস থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার শাসন অধিকার, আইন প্রণয়ণ অধিকার ও ক্ষমতা যেমন ইচ্ছে এবং যারা দ্বারা ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন। 

ধারা নং – ২

মহামান্য মহারাজা এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে যে সমস্ত ব্যক্তিগত অধিকার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা ও উপাধিসমূহ ভোগ করতেন তা পূর্বের মত ভোগ করতে থাকবেন। 

ধারা নং – ৩

উক্ত দিবস থেকে মহামান্য মহারাজা রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে তার ব্যক্তিগত খরচের জন্য বার্ষিক ৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আজীবন করমুক্ত রাজন্য ভাতা পাবেন। তার মৃত্যুর পর বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকা রাজপরিবারের খরচের জন্য রাজন্য ভাতা নির্ধারিত থাকবে। এই টাকায় তার পরিবার, ব্যক্তিগত কর্মীসহ, তার বাসস্থান, বিবাহ বা অন্য উৎসবে ব্যয় করতে পারবেন। কোন অবস্থাতেই অংক কমানো বা বাড়ানো হবে না। ভারত সরকার এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছে যে, এই ৮লক্ষ ৫০ হাজার টাকা চারটি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা অন্য কোন কোষাগার থেকে অগ্রিম প্রদান করা হবে। 

ধারা নং – ৪

এই চুক্তির দিন থেকে মহারাজা তার ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পত্তির পূর্ণ মালিকানা ব্যবহার ও ভোগ করতে পারবেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ এর আগে মহারাজা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি, টাকা-পয়সার একটি তালিকা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কাছে পেশ করবেন। যদি কোন সম্পত্তি নিয়ে এই মর্মে বিবাদ বাধে  যে, ওই সম্পত্তি মহারাজ কর্তৃক দাবীকৃত সম্পত্তি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মানতে অস্বীকার করেছে, তবে সেক্ষেত্রে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য এমন কোন বিচারকের কাছে তা উত্থাপিত করা হবে এবং উক্ত বিচারকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ধরে নিয়ে উভয়পক্ষই মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। 

ধারা নং – ৫

১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ এর পূর্বে মহারাজা এবং তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ তার রাজ্যের এলাকা এবং এলাকার বাইরে যে সমস্ত ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা, সম্মান ও উপাধিসমূহ ভোগ করতেন তা তারা ভোগ করতে পারবেন। 

ধারা নং – ৬

ভারত সরকার রাজ্যের গদি (সিংহাসন) আইন, অধিকার সমূহ, সুযোগ-সুবিধা  ও প্রথা অনুযায়ী উত্তরাধিকারী রক্ষার আইন থাকছে বা তার নিশ্চয়তা দান করছে। 

ধারা নং – ৭

মহারাজা থাকাকালীন রাজ্য শাসনকালে তার কোনো ব্যক্তিগত বা অন্য কোনো কাজ বা ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ভারত সরকার কুচবিহারের কোন আদালতে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা করা যাবে না এমনকি এ বিষয়ে কোনো তদন্তও করা যাবে না। 

ধারা নং – ৮

১) ভারত সরকার এই মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করছে যে কুচবিহার রাজ্যের স্থায়ী কর্মচারীরা প্রশাসন হস্তান্তরের পূর্বে যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন তার থেকে তারা যাতে কম সুযোগ-সুবিধা না পান নতুবা ভারত সরকার তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে।

২) ভারত সরকার নিশ্চয়তা দান করেছে এই মর্মে যে, যে রাজকর্মচারীরা অবসরকালীন পেনশন পাচ্ছেন এবং যারা পেনশনের অধিকারী হবেন তারা একইভাবে পেনশনের অধিকারী, অবসরকালীন মঞ্জুরীকৃত ভাতা এবং যাবতীয় প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হবেন। 

ধারা নং – ৯

কুচবিহারের ভারতভুক্তির পূর্বে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কোন ব্যক্তির কাজ বা ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনপ্রকার দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে না।

এই এগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করেন কুচবিহারের মহারাজা জগদ্দিপেন্দ্র নারায়ণ এবং ভারত সরকারের পক্ষে ভি পি মেনন (Adviser to the government of the India Ministry of states). এই চুক্তি অনুসারে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর কুচবিহারের মহারাজা প্রজা কল্যাণের স্বার্থে ভারত ডোমিয়নে অন্তর্ভুক্ত করেন, এরপর কুচবিহার রাজ্য তিন মাস ১৯ দিন ‘গ’ শ্রেণীর রাজ্য ছিল।  রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ১লা জানুয়ারি কুচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা রূপে রূপান্তরিত হয়, এর সম্পূর্ণ ইতিহাস এখনো অজানা। মহারাজা চুক্তির সময় কুচবিহারবাসির কাছে যে অন্তিম ভাষনে বলেছেন,

“On the Solemn occasion which marks the end of a long and Happy Association, my mother and I send you our very best wishes my beloved people.”

“Whenever we may be, we shall never forget you, your loyalty and your devotion, we hope you will always maintain the peace, goodwill and harmony which has been our common heritage.”  

 “We shall always watch with keen interest your moral and material welfare and always pray for your happiness and prosperity.” 

সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ১১/ ০৯ /১৯৪৯ তারিখে এক তার বার্তায় একস্থানে বলেছেন –

“I hope therefore that the people of Coochbehar will work with single mindedness and devotion to duty as a united team for their own betterment and to achieve their due place in the political and administrative set up of India”.

vallabhai bidhan jagaddipendra coochbehar
Historical Coochbehar Merger

কিন্তু আমরা কুচবিহারবাসি, ভারতবাসী হিসেবে গর্বিত এবং ভারতের অখন্ড রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাওয়া সত্ত্বেও due to place in political and administration setup of India কতটুকু পেয়েছি ? বরং চোখের সামনে কুচবিহার রাজবাড়ির জমি ও সম্পদ বেহাত হতে দেখেছি এখানকার গর্ব রাজবাড়ির জমির বেশিরভাগ অংশের নানা নির্মাণকার্য করা হয়েছে পশ্চিমে বাঁধ দিয়ে এর সূচনা হয়েছে এখন তো আবার বাঁধের উপর পাকা রাস্তা করার জন্য রাজবাড়ীর দিকে বাধ আরো সরে এসেছে রাজবাড়ির প্রাঙ্গণের দক্ষিণের দিকে বিস্তীর্ণ অংশে স্টেডিয়াম, ইনডোর স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়েছে। এমনকি শৌচাগারও নির্মিত হয়েছে। উত্তরে বাস স্ট্যান্ড, পার্ক আবাসনের বড় বড় অট্টালিকা সারি, আমাদের গর্বের নিদর্শনকে দুই পাশে চেপে ধরেছে। পাসের স্থান দখল করেছে ইভিনিং ও বিটি কলেজ পলিটেকনিক কলেজ। ঝিলের বিরাট অংশ বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। বহু আন্দোলনের ফলে Archaeological Survey of India এর দায়িত্ব নেওয়াতে রাজবাড়ীটুকু রক্ষা পেয়েছে। শহর জুড়ে বিভিন্ন দিঘি গুলি  বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন হেরিটেজ ভবনগুলি আজ ভগ্নপ্রায় কিছু ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে|মহারাজাদের পরিকল্পিত সুসজ্জিত শহরের আজ হতশ্রী অবস্থা সত্যিই খুবই বেদনাদায়ক। 

শিক্ষা দীক্ষায় রাজ আমলের খুবই সুনাম ছিল। রাজআমলে ভিক্টোরিয়া কলেজের সুনাম ছিল। আজ তা রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেই সময় ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতে এম এ ও বি এল পড়া যেত। বহু দিন এম এ পড়ানো বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি কয়েকটি বিষয়ে  এম  এ পড়ানো হচ্ছে কিন্তু বি এল একেবারে বন্ধ। আলাদা একটি সংস্কৃত কলেজ ছিল বহুদিন থেকেই তা বন্ধ। উজ্জীবন এর পরিবর্তে কলেজের জমি অন্য কলেজকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে| নামকরা শিক্ষকরা এখন আর  এখানে আসেন না, যারা আসেন তারা নিয়মিত থাকেন না। 

ক্রিকেটীয় ক্ষেত্রে কুচবিহার কাপকে গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে। সর্বভারতীয় স্তরে এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তুচ্ছ ভাবে পরিচালনা করা হয়। মহারাজের দেওয়া আইএফএ শিল্ডেরও একই  অবস্থা। 

কুচবিহারের মহারাজার গঠিত অর্থ দিয়ে কুচবিহার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে। তার দিয়ে কি কি উন্নয়ন করেন তা জানা বা দেখার সৌভাগ্য কুচবিহার বাসীর হয়না। দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের অধীন অনেকগুলি মন্দিরের আজ হতশ্রী অবস্থা। মদনমোহন  ঠাকুরের বিগ্রহ চুরি যাওয়ার পর অন্যান্য বিগ্রহ গুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে কুচবিহার বাসী আজ খুবই চিন্তিত।  “মতিমহল”কে আজকে “কল্যাণ ভবন” করা হয়েছে। ল্যান্সডাউন হল,ভিক্টর প্যালেস এর মধ্যে রাজ ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। যক্ষ্মারোগের হাসপাতালেও আজ করুন অবস্থা। 

কুচবিহারে এখনো শিল্প স্থাপনের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তা না হওয়ায় দিন দিন বেকার সমস্যা বেড়েই চলছে।ভূমিপুত্ররা আজ পরিযায়ী শ্রমিক।রাজ শাসনের সুশৃংখল রাজ্যে আজ অশান্তির কালো ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে। রাজার তৈরি গ্রন্থাগারে  অনেকগুলি পুতি অযত্নে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। সেগুলি অথচ কুচবিহার স্টেট লাইব্রেরির সঠিক স্ট্যাটাস আজও পাওয়া যায়নি, তবে শোনা যায় এই ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরীর স্ট্যাটাস কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ( B গ্রেড)। কুচবিহারের সাহিত্য সভার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুোৎ সভার আজ হতদরিদ্র অবস্থা। এখানে অনেক পুথির হদিস নেই অথচ এই দুই প্রতিষ্ঠান কুচবিহারের সাহিত্যচর্চার মূল্যবান নিদর্শনগুলি থাকার কথা। রেকর্ড রুম থেকে রেকর্ড গুলি উদ্ধার করে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে প্রকাশ করলে তা ইতিহাসকে প্রামান্য হতে সাহায্য করত। কিন্তু রেকর্ড রুম থেকে অনেক নথি হাওয়া। অনেকগুলি নথি অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় পড়ে থাকতে থাকতে জীর্ণ ও পাঠের অযোগ্য হয়ে বসেছে। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী কাউন্সিল হাউস ভেঙে ফেলা হয়েছে।

আধুনিক কুচবিহারের রূপকার মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের সুদৃশ্য মূর্তি আজ ধ্বংসের পথে। উন্নয়নের নামে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে রাজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। ঐতিহাসিক সাবিত্রী লজ আজ বেহাল দশায় পড়ে রয়েছে ।সঠিক রূপায়ণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাজবাড়ী সংলগ্ন উদ্যানটি হতশ্রী চেহারা ধারণ করেছে। বেহাত হয়ে যাওয়া রাজবাড়ির জমি উদ্ধারের কোন উদ্যোগ নেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার। রাজবাড়ীকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ধুমধাম আয়োজন হলেও আদতে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছিল সন্দেহ লাগে। 

১৯২০-৩০ এর দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার এখানে অন্যতম মাধ্যম ছিল বিমান পরিষেবা। নীলকুঠি বিমান বন্দরে প্রথম বিমান নিয়ে নামেন ১৯৩৪ সনে হলিউডের বিখ্যাত চিত্রতারকা বিলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস জুনিয়র। বিমান নামে  পূর্বদিকের পোলো গ্রাউন্ডে। সঙ্গে ছিলেন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। ওনাকে মহারাজা শিকার করার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পাকাপাকি ভাবে নিয়মিত বিমান চলাচল শুরু হয় ১৯৩৮ থেকে এখনকার পশ্চিম দিকের Runway দিয়ে যা বর্তমানে ১০৬৯ মিটার লম্বা।  ভারতবর্ষের অনেক রাজা মহারাজা কুচবিহার বিমানবন্দর তাদের নিজস্ব প্লেন নিয়ে এসেছেন। যেখানে মহারাজা ইন্দ্রজিৎ নারায়ণের বাড়ি ছিল। এইতো সেইদিন ভগ্ন দশা সেই বাড়িটি কিভাবে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। অথচ বিমানবন্দরের সামনেই ডিএম বাংলো এসপি র বাংলো।আর আমরা চুপ করে থাকলাম। 

১৯৫০ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত নিয়মিত বিমান চলাচল ছিল। কুচবিহারে কম করে পাঁচটা প্রাইভেট বিমান সংস্থা তাদের বিমান চালাত। দিনে দু’তিনবার করে বিমান চলতো। জামিয়ার, কলিঙ্গ এয়ারলাইন্স, দ্বারভাঙ্গা এভিয়েশন, ভারত এভিয়েশন এরকম অনেক প্রাইভেট বিমান  চলাচল করত। কলিঙ্গ এয়ারলাইন্সের মালিক ছিলেন বিজু পট্টনায়ক ( প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উড়িষ্যা) তিনি নিজে বিমান চালিয়ে কুচবিহার এসেছেন।

 রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকার ফলে কুচবিহার অবহেলিত থেকে গেছে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের বিবাদের ফলে বিমান পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কুচবিহারবাসী।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ১লা জানুয়ারি কুচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা রূপে রূপান্তরিত হয়। ডঃ বিধান রায় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তা পালন করেননি। ধীরে ধীরে কুচবিহার এর ঐতিহ্য লোপ পেতে থাকে। ঐতিহাসিক রাজবাড়ী অনাদরে পড়ে থাকে। রাজবাড়ীর সীমানায় ধীরে ধীরে  পলিটেকনিক কলেজ, ইভিনিং কলেজ গড়ে ওঠে।  বাম আমলে রাজবাড়ীর উত্তর দিকে  সুন্দর একটি ঝিল তা বুঝিয়ে বাস স্ট্যান্ড করা হয়। হলুদ বাসের বাগান কেটে হাউসিং করা হয়। সুন্দর অশ্বক্ষুরাকৃতি ঝিল  বুজিয়ে ইনডোর স্টেডিয়াম করা হয়। রাজবাড়ীর দক্ষিণ দিকে দারুচিনি গাছের বাগান ছিল, যেখানে এখন ইনকাম ট্যাক্স অফিস ও নতুন পল্লী হয়েছে।  

শহরের বুকে ৩৬ টি দীঘি ছিল। এখন হাতে গোনা যাবে। ভবানীগঞ্জ বাজার এক ঐতিহাসিক বাজার ছিল যা চীনা কারিগর দিয়ে রাজা তৈরী করেছিলেন।

প্রজাবৎসল মহারাজা জিতেন্দ্রনাথ নারায়ণ দাতব্য চিকিৎসালয় এর নাম বদলে কুচবিহার মেডিকেল কলেজ করা হয়। যদিও বর্তমান রাজ্য সরকার মহারাজাকে সম্মান জানিয়ে মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ান মেডিকেল কলেজ এবং হসপিটাল এর নামকরণ করে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়েছে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি করেছে।

দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের অধীন অনেকগুলি মন্দিরের আজ হতশ্রী অবস্থা। ১৯৯৪সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি মদনমোহন  ঠাকুরের বিগ্রহ চুরি যাওয়ার পর অন্যান্য বিগ্রহ গুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে কুচবিহারের মানুষ চিন্তিত। বিগ্রহ চুরি যাওয়ার কিনারায় এখনো পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি সরকার। দেবোত্তর ট্রাস্টের অধীনে সাতটি শিবমন্দির ও একটি মাজারসহ বাইশটি মন্দির আছে এরমধ্যে বেনারস বৃন্দাবনের মন্দির আছে। একদা কুচবিহারে ডেয়ারি ফার্ম, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ম্যাচ ফ্যাক্টরি ছিল। শিল্পে আমরা পিছিয়ে। ক্রিকেট এর ক্ষেত্রে কুচবিহার কাপ এর নাম এখন সোনাই যায় না। সর্বভারতীয় স্তরে এই প্রতিযোগিতা অত্যন্ত তুচ্ছ ভাবে পরিচালনা করা হয়।মহারাজের দেওয়া আইএফএ শিল্ডেরও একই  অবস্থা।  শিক্ষায় কতটা এগিয়ে ছিল তা সকলেই জানে। রাজনগরের বিখ্যাত রাজপথ। এত সোজা রাজপথ আর কিছুদুর পর পরই মন্দির ও দিঘি। ভারতবর্ষের আর কোথাও এমন শহর খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে আগে রাস্তা হয়েছে পরে বাড়িঘর হয়েছে। এক কথায় সে আমলের একমাত্র পরিকল্পিত শহর আজ বিবর্ণ। শহরের ড্রেনের কথা বলতে গেলে তো শেষ করা যাবে না। 

 পঞ্চাশের ভারতভুক্তি কুচবিহার এগিয়েছে না পিছিয়েছে?

কুচবিহারের নিজস্ব লোকসংস্কৃতির ভান্ডার পূর্ণ হলেও তা চর্চা ও গবেষণার জন্য কোন কেন্দ্র স্থাপিত হয় নি। এখানে প্রাচীন কীর্তিকাহিনী স্মৃতি তথা ঐতিহাসিক ও সংস্কৃতি বিষয়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ভাবনা, সামাজিক রীতিনীতি, সাহিত্য-সঙ্গীত, লোকউৎসব, স্থাপত্য, চারু ,কারুশিল্পের পরিপুষ্ট ইতিহাস বর্তমান। সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এখানে প্রয়োজন ছিল একটি আন্তর্জাতিক মানের কালচারাল হাব। বর্তমান সরকার চেষ্টা করলেও, ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব। অনুন্নয়ন এখানকার একটা বড় সমস্যা। অসন্তোষ, হতাশা, ভূমিপুত্রের অধিকার ও চেতনা থেকে জন্ম নেয়  সরকার বিরোধী রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের। পশ্চিমবঙ্গের সংযুক্তিকরণ এর দিনও ডঃ বিধান চন্দ্র রায় অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তা গুড়ে বালি। কেন্দ্র সরকার ও প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ। ভারতভুক্তি কুচবিহারের কাছে আশির্বাদ না অভিশাপ?

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)