কলিন্দ্রনাথ বর্মণ এর জন্ম ও পড়াশুনা
কামতাপুরী ভাষা সাহিত্যের (Kamtapuri Literature) একজন প্রবাদ পুরুষ ছিলেন শ্রী কলিন্দ্রনাথ বর্মণ (Shri Kalindranath Barman)। বর্তমান বাংলাদেশের বোদা উপজেলার (Boda, Bangladesh) দেবীগন্জে কলিন্দ্রনাথ বর্মণ মহাশয় জন্ম গ্রহন করেন। তিনি দেবীগন্জ উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং ছোটোবেলা থেকেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। দেবীগন্জ হাইস্কুলে (Debiganj High School) তিনি কৃতি ছাত্র ছিলেন।
রায়সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার (Raisaheb Thakur Panchanan Barma) আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রাবস্থায় পড়াশুনা ছেড়ে কিশোর বয়সে সাধুর বেশে দেশ ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। দেশভাগের (Partition of India) সময় প্রাণ রক্ষার জন্যে জীবন জীবিকার তাগিদে পূর্ব বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসে নেপালের মোরঙ্গ (Morang, Nepal) অন্চলে গৃহশিক্ষতার কাজ করেন। তাঁর পরিবার আর্থিক ভাবে দীন হলেও তিনি বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কামতাপুরী (রাজবংশী), বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি এমনকি নেপালি ভাষাতে বলতে, পড়তে ও লিখতে পারতেন। ওনার লেখনির মধ্যে সহজ সরল ভাষার যেমন সুন্দর মিশ্রণ ও অটুট বন্ধন তথা ছন্দ পাওয়া যায় তেমনি হাতের লেখাও খুব সুন্দর।
সাহিত্যিক, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ - কলিন্দ্রনাথ বর্মণ
কলিন্দ্রনাথ বর্মণ মহাশয় সাহিত্যিক ছাড়াও সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। “নয়া ডেগর” (Noya Degor) ছিল তাঁর অন্যতম কবিতা সংকলন। কলিন্দ্রনাথ বর্মণ মহাশয়ের কলমে সমাজের হিতের অনেক কথা ফুটে উঠেছিল। তিনি শিলিগুড়ি (Dabgram, Siliguri) নিকটে ডাবগ্রামে পন্চানন আশ্রম (Panchanan Ashram) প্রতিষ্ঠা করে এখানেই বসবাস করা শুরু করেছিলেন। কলিন্দ্রনাথ বর্মণ মহাশয়ের অনন্য কৃতিত্বের মধ্যে অন্যতম হল কামতাপুরী (রাজবংশী) ভাষার অভিধান যা “রাজবংশী অভিধান” (Rajbanshi Dictionary) নামে সকলের কাছে পরিচিত।
Rajbanshi Dictionary
কলিন্দ্রনাথ বর্মণ মহাশয়ের কয়েকটি কবিতার নাম হল –
আপন পায়ে দাঁড়াও (Apon paye darao), কিতায় এই দুর্গতি (Kitai ei durgati), জাতির চিকন ভাষা (Jatir Chikon Bhasha), থাকিস্ না আর ঘরে (Thakis na ar Ghore), মাথাগণতি (Mathagonti), কিতায় পারিমো না? (Kitai parimo na?), ধেত্তোর আংসাং (Dhettor Angsang), ভোটের উজাই (Bhoter ujai), ডিংগাউ ডিংগাউ (Dingau Dingau), নিদান চাউলিয়া যুগের কাথা (Nidan chaulia juger katha), আব্বাসউদ্দীনক নমস্কার (Abbasuddinok Nomoskar) ইত্যাদি।
ভোট বা নির্বাচনের আগে নেতাদের বাড়ি বাড়ি ভোট প্রচার নিয়ে ওনার একটি সুন্দর কবিতা রয়েছে। কবিতাটির নাম “ভোটের উজাই” (Bhoter ujai)
ভোটের উজাই
দেশত্ নাগে যেলা ভোটের মস্ত বড় ধূম
বড় বড় নেতাগেলার সেলা না হয় ঘুম।
নেতাগেলা বান্ধি নানারকম পাটি
ভোটের তানে করে উজান ভাটি।
যেনং পুটি মাছের যেলা নাগে ডেঁও
কণেকও না মানে আর বাঁহি সেঁও।
কত দেখিম্ ভাই ভোটের ভেকধারী
কাঙালের বন্ধু সাজি বেড়ায় বাড়ী বাড়ী।
নেতাগেলা ভোটের বাদে হয় বাহির
উম্যা নিজের বাহাদুরী করে জাহির।
জিবি হাতে নিকিলিয়া দেয় পান-বিড়ি
হবার চাহে হামার মেম্বার মনতিরি।
কত নেতা আসে হামার ভাঙ্গা খেড়ের ঘরে।
ভোট ফুরালে বন্ধুর দেখায় হওয়া ধাই।
যেলা খায়া রহি হামরা আধা পেট
সেলা দরদী বন্ধুর হামা না পাই ভেট।
যেনং দহলাত্ নাগে যেলা উজাই
ব্যাঙে ডবা চৌকা সেলা হয় বোঝাই।
কোন্ঠে হাতে আইসে হলদিয়া ব্যাঙ
বড় বড় হলদিয়া ব্যাঙের লম্বা লম্বা ঠেং।
ঐ মতন যেলা নাগে ভোটের ধুম
ডডারি-ফপারিতে হামার না হয় ঘুম।
ঐ মতন হলা ব্যাঙের মত নেতা যায়
দেশের কতখানি মংগল করিবে তায়।
সোনা-রূপা চিনা যায় পাথরত্ ঘষিলে
বন্ধুবান্ধব চিনা যায় বিপদত্ পড়িলে।
ড়ির অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে তাঁর নিচের লেখা “ধেত্তোর আংসাং” (Dhettor Angsang) কবিতাটি সত্যিই সেই যুগে চোখ খুলে দেওয়ার মতন।
ধেত্তোর আংসাং
ধেত্তোর আংসাং নোকক্ কি কর মুই
ছাওয়াটাক কিতায় স্কুলত না পাঠাইস তুই?
ছাওয়াটাক কিতায় না শিখাবো লেখাপড়া
ছাওয়াটাক্ দুঃখত ফেলাবো কি সারাজীবন ভরা?
চোখ থাকিতে না পাবে দেখা দিনোতে আন্ধার
ঠগে ঠগাবে কেবল হাল বহায় হোবে সার।
সোনা উপজিয়া খাবার বেলা খাবে ছাই
নাই জনে ঠগাবে সারা জীবনটা হবে বারোজাই।
এক গুণ দামের জিনিষের নিবে তিন গুণ
শেঠগেলা ছাওয়াগেলার চুষিয়া খাবে খুন।
গাঁওয়ের দেউনিয়া আর ছোট বড় যত বাবু,
ঘুষ নিতে নিতে ছাওয়াগেলাক করিবে কাবু।
ভাইরে এই দিনত্ বাঁচিয়া থাকিবার যদি চাও
সংগত করি ছাওয়াগেলাক লেখাপড়া শিখাও।
সাংঘাতিক যুগত্ হামরাগেলা করেছি বাস
লেখাপড়া না শিখালে সিদায় হোবে সর্বনাশ।
দেশ বিদেশ চাইরোপাখে পড়িছে হৈ চৈ
হামরা নিন্দত্ পড়িয়া কেনং করিয়া রৈ?
নাইরে ভাই আর নিন্দিবার সময় নাই ,
আংসাং কথা আর শুনিবার নাহি চাই।
সংগত করি ছাওয়াগেলাক লেখাপড়া শিখা চাই
লেখাপড়া ছাড়া নাইরে ভাই আর গতি নাই।
বোকা হয়া রহিলে কাহ না মরিবে হাতে
কিন্তু এ কথা ঠিক বোকা হলে মারিবে ভাতে।
------------------------------------------------
“সেকালের কথা” (Sekaler Kotha) কবিতাটিতে কবি সহজ সরল ভাষায় সাবলীল ভাবে মনের কথা ব্যক্ত করেছেন।
সেকালের কথা
তরাই আইনু বাঘ তাড়াইনু
জঙ্গল করিনু সাফ,
খড় কাটিনু ঘর বানানু
খেদানু বনের সাপ।
খুটা কাটিনু লাঙ্গল বানানু
লাগানু বাঁশের ফাল,
মাটি খুঁড়িনু আলি বান্ধিনু
ঠাসিয়া ধরিনু হাল।
রোয়া গাড়িনু ধান ফলানু
কৃষিকাজে দিনু মন,
রাস্তা বানানু হাট বসানু
বেচানু আলু বেগন।
এন্ডা গাড়িনু তেল বানানু
জ্বালানু এন্ডার বাতি,
পাট গাড়িনু সিঞ্জা পাইনু
তাড়ানু বনের হাতী।
শন ফেলানু সুতা পাকানু
বানানু ফানদি জাল,
বাশ কাটিনু ছাতি বানানু
কাটিলাম বর্ষাকাল।
খলৈ বানানু মাছ মারিনু
আন্ধিনু মাছের ঝাল,
গাই পুষিনু দই পাতিনু
সিদ্ধ কৈনু সরু চাল।
মাটি আনিনু মাথা ঘষিনু
চিকিনা মাটি দিয়া,
বাজার গেনু ধান বেচিনু
মণে দুই আনা নিয়া।
--------------------
কোচ রাজবংশী (Koch Rajbanshi) সমাজে যাতে পনপ্রথা চালু (Dowry system) না হয় সে ব্যাপারে কবি সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছেন নিচের “গাভুর চেঙ্গেরির খেদ” (Gavur Chengrir khed) কবিতার মাধ্যমে।
গাভুর চেঙ্গেরির খেদ
মোর নিরাশীটার অনুরাগে তনু কানদে,
হোকোর জিউটা মোর বাঁওএ না বান্ধে।
বানার জলের মত মনটা হইচে সচকার,
কণেকও বান্ধিয়া রাখা না যায় আর।
লোকে যেমন ময়না পুষে পিঞ্জিরায় ভরিয়া,
এ মত নারীর যৌবন রাখিছু মুই বান্ধিয়া।
রস যাছে, বয়স যাছে, যৌবন হছে দূর
আর কত দিনে পিন্ধিম্ কপালত্ সিন্দুর।
হায়রে মোর পোড়া কপাল বিধি হৈছে বাম
মুই অভাগিনীটা কতদিনে শ্বশুরবাড়ী যাম্।
হামারও দেশটাত আইচ্ছে দখিনা বাতাস,
বাতাস দেখিয়া দিলত্ নাগেছে হাতাশ।
কঠিন শোষণত পড়ি বাপ মোর হৈছে হাউরিয়া,
বাপ মোর পান্জির খেও ফেলাইছে আউলিয়া।
কোনঠে পাবে সাইকেল, কোনঠে পাবে ঘড়ি,
এইলা চাহেছে চেঙ্গেরালা শিখিয়া লেখাপড়ি।
তুইরে চেঙ্গেরা আজ না বুঝিবো, বুঝিবো কাইল,
হাত ধরিয়া পার করাবে যেলা বড় বড় আইল।
তুইরে চেঙ্গেরা যেলা হবো দুই তিন বেটির বাপ,
এইটা ঢং সমাজত্ ঢুকালে তোক কায় করিবে মাপ।
কয়দিন পাছত্ মিটিবে তোর শুংশুংগানি,
সমাজের করিবো হানি চোখের ফেলাবো পানি।
একটা চেঙ্গেরিক করির যদি না পারিস উদ্ধার,
বি. এ. পাশ করিয়া সমাজের কি হোবে উপকার?
হিনং আই. এ, বি. এ পাশক না কর মুই নমস্কার,
যার দিলত্ কনেকও দিলদরিয়া নাই যার।
ক্ষত্রিয়ের ছাওয়া তুই না করিস সেলেকপেচেক,
মহাভারতকেনা তুই চোখ দুইটা মেলিয়া দেখেক্।
-------------------------------
শুংশুংগানি, কলিন্দ্রনাথ বর্মণ, রাজবংশী অভিধান, কামতাপুরী (রাজবংশী), কলিন্দ্রনাথের কবিতা, রাজবংশী কবিতা, কোচ রাজবংশী কবি, kalidranath barman, shungshungani, poem of kalindranath, rajbanshk poem, koch rajbanshi poet, noya degor, নয়া ডেগর, //Reference: Satbhaiya by Dr. Girijashankar Roy.