মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি বা শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারী ছোটখাটো যেসব প্রোজেক্ট বা প্রচেষ্টা থাকে সেগুলো বাদ দিলে নেতা (MLA, MP সহ সবাই) বা মন্ত্রীর তরফে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
এখানে সবাই চটকদারী দেখিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট পাওয়ার চেষ্টা করে, যেমন অনুষ্ঠানের জন্য পয়সা বরাদ্দ, ক্লাবের জন্য অনুদান ইত্যাদি। আগে কোচরাজবংশী সমাজ (Kochrajbanshi Society) অতটা সচেতন ছিলনা, রাজনৈতিক ভাবে সমাজের বেশীরভাগ অংশ টাই ছিল অন্ধকারে, চাওয়া পাওয়াও কিছু ছিলনা। কিন্তু বর্তমান সমাজ অনেকটা সচেতন হয়েছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে ঠেকে, নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছু টা জানতে পেরেছে। আগে কি ছিল এবং অনেক কিছু হারানোর পর বর্তমানে কি আছে এটা অনেকেই বুঝতে পেরেছে। পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিও ভোটের আগে ইস্তাহারের ফুলঝুড়ি দিচ্ছে। আখেরে সমাজ তথা এই অন্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে কেউই কিছু করছে না। অরাজবংশী সমাজের বেশীর ভাগটাই ছোটোখাটো ব্যবসার (দোকান) সাথে জড়িত। ওনাদের একটা অংশ বাইরে থেকে আসা প্যাকটেজাত দ্রব্যের (Industrial Products) থেকে লাভ্যাংশ রেখে বিক্রি করে আর একটা অংশ কৃষিজ দ্রব্য বা শাক সব্জি চাষীদের (বেশীরভাগটাই কোচরাজবংশী ) কাছ থেকে কিনে লাভ রেখে শহরে বিক্রি করে। কৃষিজ দ্রব্যের মূল্য কে নির্ধারণ করে সেটা কৃষকরাই জানে না, ফড়েরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা উপকৃত হচ্ছে । ফড়েদের সংগঠনও মজবুত হয় অথচ চাষীদের সেই অর্থে কোনো তালমিল নেই। নিচের FB post দেখলে বুঝতে পারবেন।
উত্তরবঙ্গের মানুষের গড় আয় (per capita income)?
গড় আয় বা Per Capita income কথার অর্থ হল কোনো স্পেসিফিক জায়গার (শহর হতে পারে, দেশও হতে পারে) একজন মানুষের একবছরে যে গড় আয়। ঐ জায়গার মানুষের মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে গড় আয় বা per capita income পাওয়া যাবে। উত্তরবঙ্গের কোচরাজবংশী আর অরাজবংশী মানুষের per capita income জানিনা কত তবে ভারতের অন্যান্য রাজ্য বা দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় বেশী হবে না আশা করি। কারন এখানে কৃষি কম বেশী আছে, শিল্প নেই। সব থেকে বড় ব্যাপার হল জনঘনত্ব খুবই বেশী। ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের রিফিউজি হাব বললেও খারাপ কিছু বলা হবে না।
কৃষি এবং শিল্প (Agriculture and Industry)
কৃষি এবং শিল্প এই দুটি যেকোন জায়গার অর্থনৈতিক উন্নতির অন্তরায়। কৃষি উৎপাদন আছে ঠিকই কিন্ত কৃষি ভিত্তিক শিল্প সেই অর্থে নেই। এখানকার কৃষিজ উৎপাদন যেমন ধান, পাট, তামাক, আলু, চাপাতা, আনারস, সরষে সহ বিভিন্ন শাক সব্জি। ফলের মধ্যে কমলা লেবু, আম (মালদা) প্রধানত। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এইসব কৃষিজ উৎপাদন থেকে প্যাকেটজাত কোনো প্রোডাক্ট তৈরীর কারখানা এখানে নেই। শিলিগুড়ির আশে পাশে আনারস প্রসেসিং এর দুই একটা ফ্যাক্টরি রয়েছে তবে বেশীরভাগটাই বাইরে চলে যায় প্রোসেসড ও প্যাকেটজাত হওয়ার জন্য। শিলিগুড়িতে শিল্প বলতে গোডাউন রয়েছে। বাইরে থেকে প্যাকেটজাত দ্রব্য শিলিগুড়ি তে আসে স্টোর করার জন্য। তারপর শিলিগুড়ি থেকে সিকিম, দার্জিলিং সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিতরন করা হয়। আর বেশীরভাগ গোডাউন কোনো না কোনো মারোয়ারি সম্প্রদায়ের। ভুমিপুত্রদের না আছে নিজস্ব কারখানা, না আছে নিজের জায়গায় কাচামাল সরাসরি বিক্রি করার জন্য বড় কোনো কোম্পানির কারখানা। যে দুই একটা কারখানা আছে তাও বাইরে থেকে কাচামাল নিয়ে এসে প্যাকেটজাত করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে।
এখানে যেসব ব্রান্ডেড ফ্যাক্টরি আছে তার কাচামাল আসে বাইরে থেকে আর যা কাচামাল পাওয়া যায় তার ফ্যাক্টরি এখানে নেই। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই কাচামালের যোগান বা ফ্যাক্টরি নির্মান সম্ভব।
ধরুন ডলোমাইট (Dolomite) যা সিমেন্ট (cement) তৈরীর জন্য কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ডলোমাইট এখান থেকে সংগ্রহ করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় আর বাইরের রাজ্যের ফ্যাক্টরিতে সিমেন্ট বানিয়ে প্যাকেট করে এখানে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
চা এর ক্ষেত্রেও তাই। চা এর বাল্ক প্যাক (tea bulk pack) বাইরে পাঠিয়ে ওখানে ব্রান্ড নামের স্টিকার লাগিয়ে দিয়ে কনজিউমার প্যাক (consumer pack) করে আবার এখানে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
Tea bulk pack
পশুপালন (Animal Husbandry)
ডেয়ারী শিল্পেও (Dairy Industry) তাই, কিন্তু উল্টো। ডেয়ারীর শিল্পের ফ্যাক্টরি (dairy plant) এখানে কিন্তু কাচামাল বা কাচা দুধ আসে বাইরের থেকে। এই কাচাদুধ যদি উত্তরের জেলাগুলো বিশেষ করে কুচবিহার (Coochbehar) , আলিপুরদুয়ার (Alipurduar) , দিনাজপুর (Dinajpur) থেকে আসত তাহলে এখানকার কৃষকদের একটা ইনকাম সোর্স হত। এখানে সরকারী ভাবে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয় না যাতে দুধের উৎপাদন বাড়ে, নেতারাও চুপচাপ।
সত্যি কথা বলতে এই জেলাগুলিতে আশানুরূপ পরিমান দুধ নেই বলে বাইরের জেলা থেকে দুধ নিয়ে আসতে হয় ডেয়ারী কোম্পানি গুলোর। শিলিগুড়ি (Siliguri) সহ উত্তরবঙ্গের (North Bengal) বিভিন্ন জেলায় প্রায় 1.5 লক্ষ লিটার (1.5 lakh litre) প্যাকেটজাত দুধের (pouch milk) বিক্রির জন্য কাচাদুধ (raw milk) আসে বাইরের থেকে। এই কাচাদুধ বাইরের জেলাগুলির বিভিন্ন গ্রামের চাষীদের থেকে সংগ্রহ করে সংরক্ষণ (preserve) করে এখানকার ফ্যাক্টরি গুলোতে আনা হয় তারপর সেটাকে প্রোসেসড ও প্যাকটেজাত করে মার্কেটে পাঠানো হয়। উত্তরের এই প্রান্তিক জেলাগুলির গ্রামগুলিতে যাতে পশুপালনে উৎসাহ প্রদান করে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় এই ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারই উদ্যোগ নেই।
সাধারণ গরীব মানুষকে এককালীন টাকা বা আর্থিক সাহায্য দেওয়ার থেকে কিভাবে নিজেরা কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।
আমি মনে করি কৃষিজ দ্রব্যের প্যাকেটজাত প্রোডাক্ট উৎপাদন করার শিল্প ছাড়াও এই মুহূর্তে ডেয়ারী (dairy) বা দুগ্ধ উৎপাদন (milk procurement) করে বিক্রি করার ভালো সুযোগ রয়েছে উত্তরবঙ্গে।
ভোটের আগে সব রাজনৈতিক দল সংস্কৃতি, মূর্তি নির্মান, নামকরণ এসবের উপরে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখানকার সাধারন মানুষের গড় আয় কিভাবে বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড তো দূরের কথা প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেলনা।
©VSarkar