প্রাক ১৩৫তম জন্মদিবস এর সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা, প্রণাম এবং ভক্তি এবং ৯৯তম মৃত্যু দিবসের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি
Writen by Kumar Mridul Narayan
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ও মহারাণী সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র রাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার উডল্যান্ডস রাজপ্রাসাদে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বর। মহারাজকুমারের আদরের ডাক নাম ছিল প্রিন্স জিত।
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ তার সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষালাভের বিষয়ে খুবই মনোগ্রাহী ছিলেন। মহারাজকুমারকে প্রথমে দার্জিলিং সেন্ট পল্স স্কুলে এবং পরবর্তীতে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহারাজকুমার রাজরাজেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে লন্ডনের ইটন বিদ্যালয় ভর্তি হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান । এরপরে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা লাভ করেন এবং পরিশেষে দেরাদুনে ইম্পেরিয়াল ক্যাডেট কোরে সামরিক শিক্ষা লাভ করেন ।
মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণরা চারভাই ছিলেন, জ্যেষ্ঠ ভাই মহারাজা রাজরাজেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর, তৃতীয় ভাই মহারাজকুমার ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণ এবং কনিষ্ঠ ভাই মহারাজকুমার হিতেন্দ্র নারায়ণ। এছাড়াও মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণের তিন বোন ছিলেন, রাজকন্যা সুধীরা ও রাজকন্যা প্রতিভা এবং রাজকন্যা সুকৃতি দেবী ।
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের প্রেম ও বিবাহ
লন্ডনে থাকাকালীন মহারাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ বোনদের পরিচয় সূত্রেই আলাপ হয় বরোদা রাজ্যের গাইকোয়াড রাজবংশের শিক্ষিতা, বিদূষী ও সুন্দরী রাজকন্যা ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে এবং এবং সেই সূত্রেই তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। দিল্লি দরবারে তাদের এই সম্পর্ক আরো অটুট হয়। তবে তাদের এই সম্পর্ক বরোদারাজ সয়াজীরাও গায়কোয়াড় মেনে নিতে পারেননি। কুচবিহারের রাজকুমারকে বিবাহ করা নিয়েও নানা সমস্যা দেখা দেয়। সত্যি কথা বলতে সেই সময় পশ্চিমী ধাঁচে পাত্র-পাত্রীদের নিজের পছন্দের বিবাহ সমাজ স্বীকৃত ছিল না। যাইহোক বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর রাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট বড়দার রাজকুমারী ইন্দিরা দেবীকে বিবাহ করেন লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস হোটেলে। বিবাহের মাত্র ৬দিন (১লা সেপ্টেম্বর )পরই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহারাজা রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদুর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু ঘটলে কোচ রাজবংশের নিয়ম অনুসারে মৃত মহারাজার পরবর্তী ভাই রাজকুমার জিতেন্দ্র নারায়ণ, ২১ তম মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কুচবিহারের রাজসিংহাসনে আসীন হন ১৯১৩খ্রিস্টাব্দের ১৬ইসেপ্টেম্বর সকালবেলায়। কুচবিহার রাজ্যের প্রথা অনুসারে নতুন মহারাজার সিংহাসন আরোহণের স্মারক হিসেবে মুদ্রা প্রকাশ করা হয়। মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের নামে ১০০টি স্বর্ণমুদ্রা এবং ১০০২টি রৌপ্য মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল।
কুচবিহারে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ দক্ষ শাসক ছিলেন। সার্বজনীন শিক্ষার জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। জনকল্যাণকর কর্মে তার আত্মনিয়োগ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার শাসনকালে রাজসরকারে কর্মচারী নিয়োগের জন্য স্টেটস সার্ভিস কমিটি গঠিত হয়। রাজ্যের কৃষি এবং শিল্পের উন্নতির জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল তার সময়ে। কুচবিহার রাজ্যে টেলিফোনের যোগাযোগ উন্নতি করেন। তারা আমলেই রাজ্যের কাউন্সিল সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সর্বোপরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধোওর সমগ্র বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত তখন মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর কুচবিহার রাজ্যের অর্থনীতিকে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত করেছিলেন এবং যার ফলে রাজ্যে কোন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় নি।
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ পিতার স্মৃতিতে বিভিন্ন মহাকুমায় নৃপেন্দ্র নারায়ণ মেমোরিয়াল হল ও পাঠাগার স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯১৫ সনে তিনি দিনহাটা মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ হল এর ভিত্তি স্থাপন করেন। একই সনে মাথাভাঙ্গায় নৃপেন্দ্র নারায়ণ স্মৃতি ভবন এর সূচনা করেন। তুফানগঞ্জ নৃপেন্দ্র নারায়ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল গড়ে ওঠে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। মেখলিগঞ্জে ১৯১৬খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নৃপেন্দ্র নারায়ণ স্মৃতি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কুচবিহার শহরে নৃপেন্দ্র নারায়ণ হোস্টেল ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন একই সময়ে। এভাবেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্গীয় পিতা স্মরণে তিনি সাগরদিঘির উত্তরদিকে বর্তমান জেলা জজ কোর্টের সামনে ১৯২০খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ মহারাজা তার স্বর্গীয় পিতার পূর্ণবয়ব মার্বেল পাথরের একটি সুন্দর মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন। মূর্তির শিল্পী ছিলেন ইংল্যান্ডের জে. হোয়াইট হেড।
প্রজাবৎসল মহারাজা রাজা এবং প্রজার দূরত্ব দূর করে তিনি প্রচার মঙ্গল কামনা এবং উন্নয়নমুখী কাজের প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। সেজন্যই তিনি আজ আমাদের কাছে প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন ।
ক্রীড়ানুরাগী মহারাজা ক্রিকেট, পোলো খেলায় পারদর্শী ছিলেন। মহারাজা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘোরার সময় ছোটো ছোটো বাচ্চাদের তুলে নিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতেন এবং বাচ্চাদের সাথে হাসি, মজা, খেলা, গান করে শেষে তাদের মিষ্টি খাইয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। সঙ্গীতেও তার বিশেষ অনুরাগ ছিল। রাজবাড়ীতে মঞ্চ করে যাত্রা করার ব্যবস্থা করতেন।
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ও মহারানী ইন্দিরা দেবী সাহেবার জ্যেষ্ঠা রাজকন্যা ইলাদেবী, যুবরাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ, রাজকুমার ইন্দ্রজিতেন্দ্র নারায়ণ, রাজকন্যা গায়েত্রী দেবী ও রাজকন্যা মেনকা দেবী নামে তিন কন্যা ও দুই পুত্র ছিলেন ।
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। কুচবিহার রাজ্যে সাহিত্যচর্চার প্রসার বৃদ্ধি ঘটাতে মহারাজা এবং মহারানী ইন্দিরা দেবী সাহেবার উৎসাহে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাজকুমার ভিক্টর নিত্যেন্দ্র নারায়ণ এর সভাপতিত্বে কুচবিহারে স্বারসত প্রতিষ্ঠান “কুচবিহার সাহিত্য সভা” প্রতিষ্ঠিত হয়। কুচবিহারের প্রাচীন সম্পদ উদ্ধার, সংরক্ষণ, প্রকাশ ইত্যাদি এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রকাশিত সাময়িক পত্রিকার নাম ছিল “কুচবিহার সাহিত্যসভা পত্রিকা”। মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের সাহিত্য ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই দুটি কবিতাগ্রন্থে —28th of February -1915 and 4th of may-1917 এবং এছাড়াও তিনি Hello Darjeeling -1916 নামে একটি একাঙ্ক নাটক রচনা করেন। তার আমলে রাজ্যের প্রধান গ্রন্থাগার স্টেট লাইব্রেরী প্রভূত উন্নতি হয়েছিল।
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর মাত্র ৩৬তম জন্মদিনে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর নিউমোনিয়ায় ভুগে লন্ডনে অকাল প্রয়াত হন। গোল্ডাস গ্রীনে মহারাজা শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় ২৩শে ডিসেম্বর। মহারাজা জন্ম ও মৃত্যু একই তারিখে। মহারাজা চিতাভস্ম ১৯২৩ সনের ৮ই ফেব্রুয়ারি কুচবিহার শহরে নিয়ে আসা হয়। ১১ই ফেব্রুয়ারি নাবালক মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ক্ষত্রিয় রীতি অনুসারে শ্রাদ্ধ করেন।
প্রজাবৎসল মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুরের শাসনকাল তথা কুচবিহার রাজবংশের ইতিহাস সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়নি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। আমাদের পাঠ্যবইয়ে বিদেশের ইতিহাস, তাদের শাসনকাল, তাদের গৌরবগাথা আমরা পড়ি কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছরের কুচবিহার ইতিহাস আজও আমাদের পাঠ্য বইয়ে স্থান পায়নি, খুবই দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, এখানকার রাজনৈতিক নেতারা বা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এ বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি। যার ফলে কুচবিহারের গৌরবময় ইতিহাস এখানকার মানুষদের কাছে এখনো অজানা। নতুন প্রজন্ম হয়তো জানেই না যে কুচবিহারে এত সুদীর্ঘদিনের সোনালী ইতিহাস ছিল। ইতিহাসকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার, আপনার, সকলের। চলুন আমরা সকলে দল মত নির্বিশেষে একটাই দাবি তুলি কুচবিহারের ইতিহাস আমাদের পাঠ্যবইয়ে অতিদ্রুত অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
ছবি – কুচবিহার রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষের মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের এই তৈলচিত্র ছবিটি প্রাপ্ত হয়েছি আমার প্রিয় ভাই আবিরের সংগ্রহ থেকে ।
তথ্যসূত্র – রাজ জ্ঞানকোষ, রাজ্য কুচবিহারের রাজকাহিনী, কুচবিহার বৃত্তান্ত ও কুচবিহারের মেজো রাজকন্যা ও জয়পুরের মহারানী গায়েত্রী দেবীর আত্মজীবনী A Princess Remembers থেকে ।