কামতাপুরী সমাজে গুনীন বা ওঝা দিয়ে দ্যাও ভুত তাড়ানোর প্রচলন আদি কাল থেকে। গ্রামাঞ্চলেই এর প্রচলন বেশী। যেহেতু কামতাবেহার (Kamatabehar) বা কামতাপুরের জনজীবন কৃষি প্রধান তাই প্রতিটি শুভকাজে বিশেষ সংস্কার লক্ষ্য করা যায়। যাকে দ্যাও ধরে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য লক্ষ্য করা যায় এবং সেই হিসেবে বাড়ির লোক বুঝে যায় যে তাকে ভুতে বা দ্যাও ধরেছে। ওঝারা যার উপর দ্যাও ভর করে তার মাধ্যমে রুগীর কি সমস্যা হয়েছে সেটা জানার চেষ্টা করে। ভোঙর বা ভঙর আজও প্রচলিত গ্রাম গন্জে, ভোঙরে তিনজন মানুষ আসে, ওঝা, ঢোল বাদক আর যার উপর দ্যাও ভর করানো হয় সে। ভোঙরে অনেক রুগীকে সুস্থ হতে দেখেছি আমি নিজেই। সকাল থেকে যে রুগী পাগলের মত আচরণ করছিল অর্থাৎ তার উপর খারাপ আত্মা বা জ্বীন ভর করে তাকে পরিচালিত করছিল বিকালে ভঙর শেষে সে একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক, তার মধ্যে আর পাগলামীর বিন্দুমাত্র লক্ষন নেই। অনেক খারাপ ওঝা বা গুনীন সুস্থ মানুষের ওপর বাণ মেরে তাকে ও তার পরিবারকে বিরম্বনায় ফেলে। এক পরিবার আর এক পরিবারের উপর হিংসা মেটাতে বা ক্ষতি করার জন্য দুষ্ট ওঝার বাণের আশ্রয় নেয়। কামতাপুরী সমাজে বিভিন্ন প্রকার বাণ প্রচলিত ছিল (Baan types in Kamatapuri society)
বিভিন্ন প্রকার বাণ / Types of Baan [Kamatapuri Society]
কামতা সমাজে অতীতে যেসকল বাণের বা বাণ মারার প্রচলন ছিল তার কয়েকটির কথা নীচে উল্লেখ করা হল -
বারাে গােপালের বাণ (Baro Gopaler baan)
বারো গোপালের বাণ (Baro Gopaler Baan) খুবই ভয়ঙ্কর। এই বাণ মারলে রুগির সারা শরীর জ্বলে যায় ও মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয়। আর রুগি ১২ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।
বারো গোপাল বাণ মন্ত্র (Baro Gopal baan mantra)
বারাে গােপাল তের কালী, খসেয়া খা ফল্লার বুকের জালি, কালুয়া কামুনী বাণ বুকে বসিয়া হান্। মুই গেলে ঘুরিস্, মাের গুরু গেলে ঘুরিস্, আর অঝা গেলে বজর খ্যায়া ধরিস।
ট্যাপা বাণ (Tepa baan)
ট্যাপা বাণ (Tepa Baan) মারলে রুগির তলপেট ফুলে ওঠে। পায়খানা, পেচ্ছাব বন্ধ হয়ে বারাে ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।
নিগুম ব্ৰহ্মাণী, নিগুম নাক, ফল্লার অরং দুয়ার, ব্ৰহ্ম দুয়ার, ডিবুল নাগা, দমে দমে ফল্লার মুখত ডিবুল দিলে যমে।
হাওয়া ট্যাপা বাণ (Hawa tepa baan)
হাওয়া ট্যাপা বাণ (Hawa Tepa Baan) মারলে হঠাৎ করে পেটে গ্যাস জমে যায় ও আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
মেহেরু বুড়ি বাণ (Meheru buri baan)
মেহেরু বুড়ি বাণ (Meheru Buri Baan) মারলে আক্রান্ত ব্যক্তি পাগল হয়ে যায় এবং পাগলামি শুরু বাড়ির ও পাড়া প্রতিবেশী লোকের অতিষ্ঠ করে।
মেহেড়ু বুড়ি বাণ মন্ত্র (Meheru buri baan mantra)
মেহেরু মেহেরু বুড়ি তিরফলা সুন্দরী, সরগাে হাতে বুড়ি তুই মনচে দে পাঁও যাহা মনে হাংকু মুই তাহা মনে যা, ফল্লাক ধরিয়া হাটে বাজারে বেড়া।
মাসনা বাণ (Mashna baan)
মাসনা বান (Masna Baan) খুবই বিদঘুটে বাণ। এই বাণ মারলে আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্ত দেহে ঘা হয়।
জুগুনি বাণ (Juguni baan)
জুগনি বাণ (jugni baan) খুবই ভয়ঙ্কর। এই বাণ মারলে জ্যান্ত অবস্থাতেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে শকুনে ছিড়ে খায়। লোকমুখে কথিত আছে এই বাণ মারার পর সত্যিকারের শকুন আকাশে উড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর নেমে আসে। শত শত ভুতুড়ে শকুন আশপাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে লােকটিকে আক্রমণ করে খুবলে খেয়ে ফেলে।
ব্রহ্ম বা বরম বাণ (Brahma or Baram baan)
বরম বা ব্রহ্ম বাণ মন্ত্র (Baram baan mantra)
বাণ মারার সীমাবদ্ধতা (Limitation of Baan attempt)
ওঝারা যখন তখন কারো উপর বাণ মারতে পারেনা। বাণ মারা অনেকে সীমাবদ্ধতাও আছে (Limitation to apply Baan) । কথিত আছে “হাওয়া ট্যাপা বাণ’ ছাড়া অন্য কোনও বাণ নদী পেরােতে পারে না সুতরাং নদীর অন্য পারে থাকা কোনো লােকের ওপর বাণ মারলে সেটি এটি কার্যকরী হয় না।
অনেক ওঝা আছেন যাঁরা বাণ কাটতে পারেন। একে বলে ‘বাণ ফিরানি’। ওঝা বা গুনীনরা মন্ত্র পড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে বাণ তুলে যে ব্যক্তি বাণ মেরেছে তার কাছে সেটি ফেরত পাঠাতেও পারে। এটা সম্ভব হলে যে বাণ ছুড়েছে সে নিজেই নিজের বাণে আক্রান্ত হয়। কখনও কখনও দুই কবিরাজ বা গুণীনের মধ্যে প্রাত্যহিক দ্বন্দ্ব থেকেই যায়।
বাণ ফিরানি মন্ত্র (Baan firani mantra)
ওঝারা বাণ ফিরিয়ে নিতেও পারেন। এরজন্য তারা বাণ ফিরানি মন্ত্র (Baan Firani Mantra) উচ্চারণ করেন। "বল ফটিং এর থুনি, ফটিং হােইল চার চীর। উতাের, দখিণ, পূব, পচিম যায় ফল্লাক মারিছে বাণ, ফিরিয়া য্যায়া তার বুকোৎ হান।" এই মন্ত্র এক নিশ্বাসে তিনবার উচ্চারণ করতে হয়।