রামপুর কৃষিখামার আজ বেদখল। Rampur Agriculture Farm Dispossessed.

VSarkar
Rampur agriculture farm

মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের স্বপ্নের কৃষিখামার আজ বেদখল ও আগাছায় পরিপূর্ণ

Writer: Kumar Mridul Narayan

বেদখল রামপুর কৃষিখামার / Rampur Agriculture Farm Dispossessed

প্রজাবৎসল মহারাজারা প্রজাকল্যাণের স্বার্থে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন কুচবিহার রাজ্যে।সারা রাজ্যেজুড়ে এরকম অনেক  নিদর্শন ছিল এবং আছে। কিন্তু কেউই মহারাজাদের এই সমস্ত নিদর্শনগুলিকে রক্ষা করবার বা বাঁচাবার তাগিদ অনুভব করে না। যার ফলে আজ এই কঙ্কালসার অবস্থা। কুচবিহার রাজ্যের রামপুর কৃষিখামার আজ বেদখল (Dispossessed Rampur Agriculture Farm).  এটাই কি কাম্য ছিল?

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ (Maharaja Jagaddipendra Narayan) ভূপবাহাদুর উন্নত কৃষি ব্যবস্থা ও উন্নত মানের কৃষি পদ্ধতি প্রচলনের উদ্দেশ্যে রামপুর জোড়াই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কৃষি খামার। উদ্দেশ্যে ছিল প্রজাদের কৃষিকাজে আধুনিকিকরন করা, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা এবং আধুনিক কৃষিকাজে উৎসাহ দেওয়া। তাই চল্লিশের দশকে এই উন্নত কৃষিকাজ ও কম খরচে বেশি পরিমাণ আয়ের লক্ষ্যে তিনি রামপুরে গড়ে তুলেছিলেন কৃষিখামার। ধান, পাট, সরিষা, গম কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় তার জন্য তিনি  ইংল্যান্ডের কৃষি বিশারদ মিস্টার উইলসনকে (Mr. Wilson) নিয়োগ করেছিলেন। ধান, গম, সরিষা, পাট চাষের জন্য তিনি উন্নত মানের মেশিনের প্রচলন করেছিলেন রামপুর কৃষি খামারে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড থেকে এই মেশিনগুলো তিনি নিয়ে এসেছিলেন। বিদেশ থেকে ধান কাটা, শিষ থেকে ধান আলগা করা, জমিতে ধান রোপণ করা, পাট কাটা এই কাজগুলোর জন্য উন্নত ক্রাসার মেশিন আনা হয়েছিল এবং এই মেশিনগুলি রাখার জন্য  দোতলা  ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। লম্বা লম্বা নির্মিত ঘর গুলিতে রাখা হত ট্রাক্টর, ছোট ছোট মেশিন। শষ্য রাখার জন্যও  ঘর তৈরি করা হয়েছিল। আনুমানিক প্রায় ৫০০ বিঘা জমি এই কৃষি খামার করার জন্য মহারাজা দান করেছিলেন এবং ওখানেই তৈরি করা হয়েছিল একটি এয়ারস্ট্রীপ।

Coochbehar rampur agriculture

Rampur Agriculture farm – Coochbehar State

মহারাজা বছরে দুই-চারবার ওখানে তার নিজস্ব Two-seater বিমানে করে যেতেন এবং ফার্মের কাজের খোঁজখবর নিতেন। অস্থায়ী রাজপ্রাসাদ এর মত তাবু তৈরি করে ওখানে ক্যাম্প করতেন এবং ক্যাম্পে কিছুদিন থাকতেন। একটি কাচের ডাকবাংলো তিনি নির্মাণ করেছিলেন। টাকোয়ামাড়ি ফরেস্ট, (Takoamari Forest) নাগুরহাট শালবাড়ি ফরেস্টে শিকার করতে যেতেন এবং শিকার থেকে ফিরে ডাকবাংলোয় বিশ্রাম নিতেন। বিদেশি অতিথিরাও মহারাজার সঙ্গে  শিকারযাত্রায় যোগদান করতেন।

মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের এই কৃষি বিপ্লবের ফলে প্রজারা খুবই উপকৃত হয়েছিলেন। মহারাজা বারোকোদালী (Barokodali) অঞ্চলেও একটি কৃষিফার্ম নির্মাণ করেছিলেন উন্নত কৃষি উৎপাদনের জন্য। কৃষি ছিল কুচবিহারের  আয়ের অন্যতম উৎস। জমি ছাড়া এখানে আর কোন ট্যাক্স ছিল না। সর্বপরি কুচবিহারের মহারাজারা উচ্ছৃঙ্খল বা ব্যভিচারী ছিলেন না। তাই কুচবিহারের ভূমিপুত্ররা মহারাজাকে দেবতার মতো দেখতেন। কুচবিহারের ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক অবস্থা, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, আত্মমর্যাদার নিজস্বতা বরাবরই ছিল।ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষ থাকলেও কুচবিহার ব্যতিক্রমী ছিল। ব্রিটিশ  শাসকরা কুচবিহারের মহারাজাদের সমীহ করতেন ।

রামপুর কৃষিখামার ও রিফিউজি ক্যাম্প / Rampur Agriculture Farm and Refugee Camp

সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক চললেও ভারতভুক্তির পর পরিস্থিতি বদলে যায় । কৃষিফার্মের জায়গাগুলি চলে যায় উদ্বাস্তু ও ত্রাণ বিপর্যয় দপ্তর এর অধীনে (যদিও এর পেছনে অনেক গল্প আছে)। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্বাস্তু ত্রাণ বিপর্যয় দপ্তর এই জায়গা গুলিকে রিফিউজি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। আসাম, বাংলাদেশ থেকে আগত রিফিউজিদের এই এলাকায় কলোনি নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করে দেওয়া হয়। তৎকালীন পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী আভা মাইতি (Abha Maiti) এই রিফিউজি ক্যাম্পে এসেছিলেন। প্রথমে রিফিউজি ক্যাম্পের নাম দেওয়া হয় “ওয়েস্টবেঙ্গল রিফিউজি ক্যাম্প” (West Bengal Refugee Camp) এবং পরে এর নামকরণ করা হয় “কুচবিহার রিফিউজি ক্যাম্প” (Coochbehar Refugee Camp)। এছাড়াও মাইতি সাহেব এই কৃষি ফার্মের অনেকটা জায়গা এবং কিছুঘর দেখাশোনার জন্য এবং রামপুরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুইডিশ মিশনের অন্যতম কর্তা এলাব হুডনী সাহেবকে। এতপরিমাণ জমির মধ্যে মহারাজার তত্ত্বাবধানে সামান্য কিছু জায়গা এবং কয়েকটি ঘর ছিল। ওই এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা শিক্ষক ক্ষীরেন্দ্রমোহন সরকার বলেন, শিঙিমারি বিদ্যালয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে উন্নিত হলে কিছুদিন অস্হায়ী ভাবে কৃষিখামারের ঘর গুলিতে ক্লাস হয়েছিল। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর জীবিত অবস্থায় তার স্বপ্নের কৃষি ফার্মের দুরবস্থায় মোটেও খুশি হতে পারেননি। হয়ত খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।ভারতভুক্তি চুক্তি তার কাছে অভিশাপ মনে হয়েছিল। ১৯৭১ এর পরও পূর্ববঙ্গ থেকে আসা অনেক শরণার্থী এই কৃষি খামারে বসবাস করেছিলেন।

যাইহোক সুইডিশ মিশন ওই এলাকার দায়িত্ব পাওয়ার পর নানারকম উন্নয়নমূলক কাজ করতে শুরু করে। মিশনের বড়কর্তা ওলাব হুডনী সাহেবের নেতৃত্বে তৈরি হয় “রামপুর তন্তুজ সমবায় শিল্প কারখানা”। কৃষি বিশারদ জারহার্ড নেওফিল্ড এই কাজগুলি দেখতেন। তদারকি করতেন সুপারভাইজার ব্যাঙ্ক এগরাস। মোটামুটি ৮০ (আশিখানা) তাঁত বসানো হয়েছিল। দৈনিক প্রায় ২০০০ (দুই হাজার) শ্রমিক কাজ করতেন। রেশম শিল্প ও বিভিন্ন কাজের সুবিধার্থে হুডনী সাহেব একটি বিশাল পুকুর খনন করেন। এখনো ওই বিশাল আকার পুকুরটি “সাহেবের দিঘি” (Saheber dighi) নামে ওই এলাকায় পরিচিত। সবকিছু মোটামুটি ঠিকই ছিল, সত্তরের দশকের শেষদিকে মূলত রাজনৈতিক কারণে তাঁত শিল্পের কাজ ও নানা উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওখান থেকে একপ্রকার তাড়িয়ে দেওয়া হয় সুইডিশ মিশনের কর্তাদের। একে একে মহারাজার জমিতে গজে ওঠে কলোনি। জবরদখল কলোনি, ডোড়ারকুঠি, কানাই বিল, জোড়াই ১, ২, ৫, ৭ নং কলোনি গড়ে ওঠে মহারাজার  ফাঁকা কৃষিফার্মে।

এয়ারস্ট্রিপ এর জায়গাগুলি প্রথমে দখল না হলেও পরে একে একে বাড়ি তৈরি হয়। বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হয় না যে কোনো এক সময় ওখানে এয়ারস্ট্রিপ ছিল। ভাঙ্গাচোড়া নিদর্শন, পরিত্যক্ত এলাকা স্বচক্ষে দেখলে মন ভারাক্রান্ত হবেই। মহারাজাদের স্বপ্নকে এভাবে ধূলিস্যাৎ করা ও মুছে ফেলা মনকে অস্থির করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্তির সময় ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের প্রতিশ্রুতি ও কুচবিহার কে নতুন করে গড়ে তোলার আশ্বাস তাহলে কি গুড়ে বালি

State agriculture farm rampur

Rampur Agriculture Farm

কুচবিহার মহারাজাদের জমি, সম্পদ একের পর এক কিভাবে ভারতভুক্তির পর বেদখল হয়ে গেছে। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুর যে লক্ষ্য নিয়ে প্রজা কল্যাণের স্বার্থে  কাজ শুরু করেছিলেন সেটা যদি ঠিকঠাক ভাবে ধরে রাখা যেত তাহলে রামপুর জোড়াই আজ আর প্রান্তিক এলাকায় পরিণত হতো না। ওই এলাকার চিত্র আলাদা থাকতো। রায়ডাক নদীতে সেতু না হওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ওই এলাকার সঙ্গে জেলার খুব একটা উন্নত হয়নি। হয়তো অনেকেই জানেইনা মহারাজার এই গৌরব কীর্তি।

বর্তমানে প্রায় ৫০/৫৫ বিঘা জমি এবং কৃষিফার্মের ঘরগুলি অবহেলা, অযত্নে পড়ে রয়েছে। ঘরগুলি থেকে দামি দামি কাঠ ,আসবাবপত্র অনেক চুরি হয়ে গেছে। শুধুমাত্র মহারাজার নিদর্শন হয়ে সারি সারি ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সরকার অবিলম্বে এই জায়গাগুলোকে অধিগ্রহণ করে (যদিও ত্রাণ এবং পুনর্বাসন দপ্তর এর নিয়ন্ত্রণাধীন) ঐতিহাসিক জায়গাগুলিকে সংরক্ষণ করে এবং ঘরগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। পর্যটন মানচিত্রে স্থান দিতে পারে এই ঐতিহাসিক জায়গার।