বন্চিত জনগণ, বন্চিত নেতৃবৃন্দ, বন্চিত কামতাভুমি। Deprived Kamatabhumi

VSarkar
বন্চিত কামতা জনগন

এটা অন্ততপক্ষে ভালো দিক যে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কিছুটা হলেও বোধগম্য হয়েছে যে কামতাভুমি (Officially Uttarbanga region) সর্বদিকে বন্চিত। হতে পারে এই বন্চনার উপলব্ধি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বন্চনার সূত্রপাত থেকে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এইসব নেতৃবৃন্দরা অন্য কোনো কলিকাতা পরিচালিত রাজনৈতিক দলের কাছে শরণাপন্ন হয় এই ভেবে যে, হয়ত সেই বন্চনা থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে কামতাভুমি। আসলে সাময়িক ভাবে মুক্তি ঘটে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বন্চনার। এই প্রকৃয়া চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে আসছে। 

কামতাভুমির বন্চনার সূত্রপাত 1947 সাল থেকে। যখন ভারত স্বাধীন হয় তখন এই জায়গার স্বাধীন ভারতবাসীগণের পরাধীনতা গ্রাস করতে থাকে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হল কলিকাতা পরিচালিত সরকার ও প্রশাসন। ব্রিটিশ সরকার যেভাবে ভারতীয়দের দিয়ে ভারত শাসন করেছে, ভারতের সম্পদ লুট করে নিয়ে চলে গেছে অনেকটা সেই কায়দায় কলিকাতা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার কামতাভুমির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে এই ভুমি শাসন করেছে, এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক সম্পদ লুট করে কলিকাতায় নিয়ে চলে গেছে। বিগত 70 বছর যাবৎ এই কাজটা সুচারু ভাবে করে গেছে কলিকাতা পরিচালিত প্রশাসন তথা নির্বাচিত সরকার। এখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকেই বুঝতে পারেনি হয়ত। যারা হয়ত বুঝতে পেরেছে তাদের অনেকেই মৌনব্রত পালন করেছিল ক্ষমতার অলিন্দে থাকার দরুন।

শুধু কোচবিহার যদি ধরি তাহলে বন্চনার মাত্রা অনেক বেশী। কারণ কোচবিহার একদা রাজ্য ছিল, সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটি সাধারণ জেলায় পরিনত করা হয়েছে। এখানকার জনবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। বাকী জেলাগুলোর ক্ষেত্রেও জনবিন্যাসের পরিবর্তন লক্ষনীয়।
কামতাভুমির বন্চনাকে যদি আমরা ভাগ করি তা হল –

1. এখানকার আদি বাসিন্দাদের প্রতি বন্চনা। 

2. মাটির প্রতি বন্চনা।

এখানকার আদি বাসিন্দাদের বেশীরভাগই হল কোচ রাজবংশী, তারপরে দেশী মুসলিম, রাভা, মেচ ইত্যাদি। বাংলাভাষী (মাতৃভাষা) বাঙালিদের কিছু সংখ্যক আদি বাসিন্দা হিসেবে ধরা যেতে পারে।

আদি বাসিন্দা বিশেষত কোচ রাজবংশীদের বন্চনার মাত্রা এক্ষেত্রে সব থেকে বেশী। বন্চনার সূত্রপাত ভারত স্বাধীন ও কোচবিহার কে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় পরিনত করার জন্মলগ্ন থেকেই। কোচ রাজবংশীদের বন্চনাকে যদি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় তা হল –
A. অর্থনৈতিক ভাবে

B. ভাষাগত ভাবে

C. সাংস্কৃতিক ভাবে

D. প্রশাসনিক ভাবে

E. রাজনৈতিক ভাবে

অর্থনৈতিক ভাবে বন্চনা

অর্থনৈতিক ভাবে বন্চনা মূলত ভুমি সংস্কার এর মাধ্যমে হয়েছিল। এই অন্চলের কোচ রাজবংশী সহ অন্যান্য গোষ্ঠীর জীবিকার একমাত্র উপায় ছিল কৃষি। শিল্প বলতে কিছুই ছিলনা আগে, এখোনো সেই অর্থে নেই। প্রথমত দেশ ভাগের দরুন লক্ষ লক্ষ মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোচবিহার ও পার্শ্ববর্তী জেলায় বসবাস করা শুরু করল, কলিকাতা পরিচালিত তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই অন্চলের আদি বাসিন্দাদের বিশেষত জোতদার শ্রেণীর জমি খাস করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জমি বিলি করে দিল এবং তারসাথে তাদেরকে ভোট ব্যাংক হিসাবে ব্যবহার করার ভালো উপায় খুঁজে পেল। জনবিন্যাসের তারতম্য ঘটিয়ে কলিকাতা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভাষা সংস্কৃতিগত ভাবে আলাদা কোচবিহার কে জেলায় পরিনত করার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে ব্যতিব্যস্ত থাকল। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান পরিনতি এখানকার আদি বাসিন্দাদের অর্থনীতির বাস্তুতন্ত্রের উপর চরম আঘাত হানল। পরবর্তীতে 1971 সালে যখন বাংলাদেশ গঠন হল তখনও নতুন করে লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী মানুষ এই অন্চলে প্রবেশ করা শুরু করল। শুধু বাংলাভাষী মানুষ বললে ভুল হবে, বাঙালি সহ রংপুর ও দিনাজপুর অন্চলের অনেক কামতাভাষী কোচ রাজবংশী মানুষও এসেছে এদেশে।  ঠিক কয়েক বছর পরে 1977 সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষমতায় আসল আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সেই কলিকাতা। নতুন করে আবার ভুমি সংস্কার হল যার ফলে এখানকার আদি বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তলানীতে ঠেকল। আদি অনন্তকাল ধরে যাদের পেশা কৃষি আর সম্পদ কৃষিজমি। সেই কৃষকদের জমি যদি নিত্যনতুন আইন বানিয়ে কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা করুন হওয়াই স্বাভাবিক। প্রতি ক্ষেত্রে সরকার উদ্বাস্তুদের স্বার্থ রক্ষার্থে কিছু না কিছু করে গেল, শুধুমাত্র আদি ভুমিপুত্র দের উপর অর্থনৈতিক তলোয়ার চালিয়ে ওদেরকে খুশি করল ভোট ব্যাংকে পরিনত করার জন্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত কৃষকদের জমি খাস করে গরীব ভুমিপুত্রদের দান করলেও সেই জমি কোনো কাজেই লাগলনা। এক্ষেত্রে উভয়েই গরীবে পরিনত হল। কারন মধ্যবিত্ত কৃষকের জমি খাস করার পর যে জমি বাচল তা তার সন্তানদের মধ্যে ভাগ করার পর প্রত্যেকের ভাগে যে জমি পড়ল সেই জমি দিয়ে সংসার চালানো দুরহ ব্যাপার। আর যে গরীব ভুমিপুত্র খাস জমির ছিটেফোঁটা পেল তা দিয়ে তারও সংসার চালানো অসম্ভব। সুতরাং উভয় পরিবার কে পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য করল কলিকাতা  পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার।  

ভাষাগত ভাবে বন্চনা

ভাষাগত ভাবে বন্চনার পরিনতি আরো ভয়ন্কর। মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণের পূর্বে কোচবিহারের রাজ ভাষা ছিল কামরুপ কামতা ভাষা যা এখানকার কোচ রাজবংশী সহ অন্যান্য গোষ্ঠীর চলতি ভাষাই ছিল। মহারাজা প্রাণনারায়ণের অনেক পুঁথি নাকি কামতা ভাষাতে ছিল যা 1973-74 সাল নাগাদ কোচবিহারের লাইব্রেরী পুড়ে যাওয়ার সময় নষ্ট হয়ে যায়, অনেক পুঁথি বিভিন্ন সময়ে চুরিও হয়ে যায় চরম অবহেলার দরুন। 1773 সালে কোচবিহার ব্রিটিশের করদমিত্র রাজ্যে পরিনত হবার পর বাংলাদেশ থেকে অনেক বাংলাভাষী কর্মচারী নিযুক্ত করেন ব্রিটিশ অফিসাররা যাতে সুষ্ঠভাবে রাজ কার্য পরিচালনা করা যায়। জয়নাথ মুন্সী সহ আরো অনেক কর্মচারী নিযুক্ত হন। মোটামুটি এই সময় থেকেই কোচবিহারের রাজভাষা বাংলা হওয়া শুরু হয়। আর সমস্যাও শুরু হয় এই সময় থেকেই। কারণ রাজকর্মচারী আর রাজপরিবারের কিছু ব্যক্তি বাংলা ভাষা জানলেও রাজ্যের আপামর সাধারণ প্রজাবৃন্দ এমনকি জোতদার সহ অন্যান্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভাষা ছিল কামতা ভাষা / রাজবংশী ভাষা । মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণের সময় কারিগরি শিক্ষার সেভাবে প্রচলন না থাকলেও মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণের সময়কালে জেনকিন্স স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গতানুগতিক শিক্ষা চালু হয়। শিক্ষার মাধ্যম বাংলাই করা হয়। এবার আমরা যদি হিন্দিভাষী কোনো পরিবারের সন্তানকে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা নিতে বলি বা বাংলাভাষী কোনো পরিবারের সন্তানকে হিন্দি ভাষায় শিক্ষা নিতে বলি সেই সন্তানের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ তথা ভাবপ্রকাশ স্বাভাবিক ভাবেই আশানুরূপ হবেনা। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এখানকার আদি বাসিন্দাদের সন্তানদের। এককথায় বলা যায় মায়ের মুখের ভাষা জোড় করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে শিক্ষিত সন্তানদের কাছ থেকে। আর যারা শিক্ষিত হয়নি তারাই শুধু মাতৃভাষাকে লালন পালন করেছে, কিন্ত প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তারা কোনো জায়গা পাইনি, কারণ শিক্ষা নেই। এই ধারা আজও বয়ে চলেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যখন নিজের মাতৃভাষা বর্জন করে শুধুমাত্র গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য বাংলা ভাষাকে রপ্ত করেছে চাকরী পাবার আশায়, ফলশ্রুতিতে একই সমাজে দুটো শ্রেণী তৈরী হয়েছে। এক হল বাংলাভাষী তুলনামূলক শিক্ষিত শ্রেণী আর এক হল কামতাভাষী গতানুগতিক শিক্ষিত নয় এমন শ্রেণী। যারা শিক্ষিত হলনা তাদের মধ্যে যেমন হীনমন্যতা চলে আসল তেমনি যারা তুলনামূলক শিক্ষিত হল তাদের মধ্যেও হীনমন্যতা বোধ চলে আসল। প্রথম শ্রেণির মধ্যে রাজভাষা বাংলা বলতে না পারার জন্য বিভিন্ন অফিস কাছারিতে প্রয়োজনীয় কাজ করতে গিয়ে হীনমন্যতা। আর দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে বাংলা শিখেও চাকরীর সুবাদে বিভিন্ন অফিস কাছারিতে নিজের মাতৃভাষা যাতে মুখফস্কে না বেড়োয় সেই আড়ষ্টতা। যদি অফিসের অন্যান্য বাংলাভাষী সহকর্মী শুনে ফেলে তাহলে কি ভাববে, এই ভেবে ভিতরে ভিতরে চাপা হীনমন্যতা বোধ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই অন্চলের আদি বাসিন্দারা মোটামুটি 1960-65 সাল নাগাদ যখন উপলব্ধি করল যে মাতৃভাষা কামতায় শিক্ষালাভ করা জরুরি অতঃপর ভাষার অষ্টম তফসিল করার জন্য আন্দোলনও শুরু হল। কিন্ত বন্চনার মাত্রা এতটাই তীব্র যে আজ অব্ধি ভারত সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কামতা বা কামতাপুরী ভাষা নিয়ে কোনো রকম ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলনা। কামতাপুরী ভাষাভাষী মানুষদের বন্চনার ক্ষেত্রে বর্তমান কলিকাতা পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরো একধাপ  এগিয়ে। তারা একই ভাষার দুই নাম দিয়ে দুটো অ্যাকাডেমি বানিয়ে দিয়েছে যাতে রেলগাড়ি দুটি সমান্তরাল সরলরেখার উপর দিয়ে অবিরাম গতিতে চলতে থাকে, কোনো সুরাহা নাহয়, এই ভাষায় পঠনপাঠন ইহজন্মে কোনো সন্তানই যাতে করতে না পারে।

সাংস্কৃতিক ভাবে বন্চনা

সংস্কৃতিগত ভাবেও কামতভুমির আদি বাসিন্দারা বন্চিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো কালেই এখানকার সংস্কৃতি কে প্রাধান্য দেয় নি। ভাওয়াইয়া গান যা কামতা সংস্কৃতির অন্যতম সঙ্গীত সেটার জন্য সরকার কোনো রকম অর্থ সাহায্য করতনা (দেশ স্বাধীনের 20-30 বছর পর্যন্ত বলা যেতে পারে) । যারা শিল্পী তাদের জন্য কোনো পুরস্কার, স্মৃতি পুরস্কার কোনো কিছুই নেই। কলিকাতা পরিচালিত সরকার প্রতিটি মহকুমায় সিনেমা হল খুলে দিয়েছিল বাংলা সিনেমার প্রোমোশনের জন্য আর বাংলা সংস্কৃতির প্রচারের জন্য। কলকাতায় প্রোডাকসন করবে ওরা আর বিক্রি করবে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি সহ উত্তরের অন্যান্য জেলাগুলিতে যেখানে বেশীরভাগ মানুষের সংস্কৃতি বাংলাই নয়।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কয়েক দশক পর্যন্ত উত্তরের সংস্কৃতির প্রসার ও প্রচারের জন্য সরকারী কোনো সুবিধাই ছিল না। যতটুকু চল ছিল তা সাধারন গ্রামীন সংস্কৃতি প্রেমী মানুষের বদান্যতায়।

কুশান গান, বিষহরি, মারাই পূজা, মদনকাম গান, ভান্ডানী পূজা, আমাতি পূজা, আটকালাই বাটকালাই খাওয়া, গোরনাথ মাগা, গোষ্ঠ পূজা, মেচেনি গান, রাবান গান, গমীরা, বেষমা উৎসব, ভোগা বা কাতি গছা, নয়া খাওয়া, গেরাম দেবতা, ধরম ঠাকুর, কোয়ালি গান, সত্যপীরের গান, বিভিন্ন জাগার যাত্রা পালা, হুদুম দেও  ইত্যাদি – এই সবের ছিটেফোঁটাও কি কোনো বাংলা চলচ্চিত্রে পেয়েছেন? পাননি কারণ এইসব যেমন বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ নয় তেমনি অহমীয়া সংস্কৃতির অঙ্গও নয়। সবই কামতা সংস্কৃতির অলঙ্কার। অনেকে জোড় করে শুধুমাত্র রাজবংশী সংস্কৃতির কথা বলতে পারে, সেটাও ঠিক নয়। কারন এই সবকিছুই রাজবংশী বা কোচ রাজবংশী জাতির একক সংস্কৃতি নয়।

প্রশাসনিক ভাবে বন্চনা

কোচবিহার কে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় পরিনত করার সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতা পরিচালিত প্রশাসন বুঝতে পেরেছিল যে এই অন্চলে প্রশাসনিক ভিত শক্ত করার প্রয়োজন আছে যা বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি তথা বাংলা আদব কায়দা রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছাতে সাহায্য করবে। প্রশাসন সর্বদাই বাংলা অন্ত প্রাণ ছিল। ধীরে ধীরে সরকার প্রশাসনের সাহায্যে ঐতিহাসিক স্থানগুলো কব্জা করা শুরু করলো। বিভিন্ন রাস্তার নাম পরিবর্তন করা হল। যেমন “নয়ার হাট” হয়ে গেল “নতুন বাজার”, “পখি হাগা” হয়ে গেল “পাখি হাগা”

বাংলাভাষী তফসিলি সম্প্রদায়ের কাউকে ডেকে ডেকে কাস্ট সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে সেখানে কামতাভাষীর কারো অফিসে যেতে যেতে চটি ক্ষয় হয়ে গেলেও কাস্ট সার্টিফিকেট পাচ্ছেনা। বিভিন্ন ডকুমেন্টস এর জুজু দেখিয়ে তাদেরকে হয়রানি করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসার লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও একই রকম, কামতাভাষী প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে সরকারী অফিসার বাবুদের নিয়ম আলাদা আর বাংলাভাষী ব্যবসায়ীদের নিয়ম আলাদা। ভুমিপুত্র ব্যবসায়ীদের অনেকে প্রশাসনের অত্যাচারে সর্বস্বান্ত হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশের কাছেও নালিশ জানাতে গেলেও ঐ একই অবস্থা। কামতাভাষী মানুষ দেখলেই কলিকাতা পরিচালিত বাঙালী অফিসার বাবুরা অন্যভাবে ট্রিটমেন্ট করে সে গরীব হোক, মধ্যবিত্ত হোক, উচ্চবিত্ত হোক, জমি ওয়ালা হোক, ভুমিহীন হোক, ব্যবসায়ী হোক আর চাকরীজীবী হোক।

গরীবের ক্ষেত্রে – যেকোনো টার্গেটই সফ্ট টার্গেট।

মধ্যবিত্ত – অশিক্ষিত হলে অফিস আদালতে হয়রানি, শিক্ষিত হলে যেকোনো টালবাহানা করে হয়রানি।

উচ্চবিত্ত হলে – কি ভাবে তার কাছ বেশী টাকা খসানো যায়।

জমি ওয়ালা – খাজনা নিয়ে হয়রানি, প্রশাসনের সাহায্যে জমি দখল করার হয়রানি।

ভুমিহীন হলে – লেবারের কাজের জায়গায় দুর্ব্যবহার। জাতপাত নিয়ে খোটা। 

ব্যবসায়ী হলে – অডিট, ইনকাম ট্যাক্স, অ্যাপ্রোভাল ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে হয়রানি।

রাজনৈতিক সংযোগ থাকলে তো আরো নিত্যনতুন উপায় হয়রানির।

চাকরীজীবী হলে – অফিসের বাঙালি বস এর কাছ থেকে খোটা, সহকর্মীর কাছ থেকে খোটা। অযাচিত বদলি ইত্যাদি। 

রাজনৈতিক ভাবে বন্চনা

রাজনৈতিক ভাবে বন্চনার ভয়াবহতা আরো মারাত্মক। তা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে অনুমেয়। 1950 সাল থেকে যদি ধরি প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেই কামতাভুমির আদিবাসী বিশেষত কোচ রাজবংশী জাতি থেকেই এমএলএ ও এমপি ছিল অনেকাংশে। কিন্ত এটাও লক্ষনীয় যে প্রতিটা দলেই তারা ছিল ঠুটো জগন্নাথ। কলিকাতা/দিল্লী পরিচালিত যখন যে দল ক্ষমতায় আসার জন্য লড়াই করেছে তখনই তুরুপের তাস হিসাবে কোচ রাজবংশী কোনো না কোনো ব্যক্তিকে সামনের সারিতে রেখেছে। সামনের সারিতে এইজন্যই রেখেছে যাতে তাদের মাধ্যমে গ্রাম এর সাধারন কোচ রাজবংশী মানুষের মন জয় করা যায়, পাশাপাশি জনবিন্যাস পরিবর্তন করে বেশী বেশী করে বাংলাভাষী সাধারণ মানুষকে এই অন্চলের বাসিন্দা করে দিয়েছে (বেশীরভাগ বাংলাভাষী সাধারণ মানুষ এসেছে বাংলাদেশ অথবা পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্য থেকে) যাতে রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে কামতাভাষী কোচ রাজবংশীর আধিপত্য ধীরে ধীরে খর্ব হয়।

 যখনই ক্ষমতায় চলে আসে তখন আর কোচ রাজবংশী মুখ গুলিকে সামনের সারিতে না রেখে পিছন থেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিতে রাখা হয়। কাকে কোন সারিতে রাখা হবে তা নির্ভর করে ঐ নেতা ব্যক্তির বাংলা আনুগত্যের উপর ও কলিকাতা প্রশাসনের দয়ার উপর।

 স্বভাবতই এখানকার নেতৃবর্গ পদ হারাবার ভয়ে আনুগত্যের পাঠ শিখে নেয় ও সাধারন জনগনের মধ্যেও তা সন্চার করার চেষ্টা করে। সাধারণ জনগনের কেউ সন্চারিত হয়, কেউ হয় না। যে হয়না সে নিজের জাতভাই নেতার দ্বারাই হয়রানি হতে থাকে। গ্রাম লেভেলে যেসব শিক্ষিত /অর্ধশিক্ষিত নেতা থাকে তাদের মধ্যেও বাংলা আনুগত্যের মাপজোক হয়। মোট কথা ক্ষমতায় আসার আগে কোনো আনুগত্য দেখা হয় না কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুরু হয় আনুগত্যের মাপজোক। তবে দুঃখের বিষয় এত কিছু বোঝার পরেও অনেক শিক্ষিত মানুষ কলিকাতা পরিচালিত রাজনৈতিক দলের পিছনে ছোটে ব্যক্তিগত লাভের আশায়। মানে সাধারন কামতাভাষী, কামতা সংস্কৃতি মানুষের ভোট নিয়ে জিতে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ কে কায়েম করার চেষ্টায় রত বাংলা আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে। তারা এটাও জানে যে ক্ষমতায় আসলে তারা আর প্রথম সারিতে থাকবেন না। তাদের কাছে কোনো কতৃত্ব থাকবেনা, তারা কাউকে একটা চাকরী দিতে পারব না (বড় জোর নিজের পরিবারের বা নিকট আত্মীয়ের দুই একজনের চাকরী ম্যানেজ করতে পারবে), কোনো ব্যবসার সংস্থান করতে পারবেনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর কড়া আঘাত হলে রাস্তায় দাড়িয়ে নিজের দলের উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুটো কথা মুখ ফুটে বলতে পারবে না। রাস্তায় দাড়িয়ে বলা তো দূরের কথা গোপনে দুটো লাইন লিখে চিঠি পাঠাতে পারবে কিনা সংশয় আছে।

রাজনৈতিক বন্চনা এনারা নিজেরাই ডেকে নিয়ে আসছে। “এসো আমার দ্বারে, বন্চিত করো আমারে”। আসলে এটাও ভুল কথা, বন্চিত তো ঐ নেতা হবেনা। গাড়ি পাবে, মাসিক বেতন পাবে, পেনশন তো আছেই, “মুই কি হনু” তকমা পাবে, বাড়িতে সবসময় কিছু লোকের লাইন লাগবে, এই মিটিং, ঐ মিটিং, CM call করছে, PM call করছে, এলাহি ব্যাপার স্যাপার। বন্চিত তো হবে গ্রাম এর সহজ সরল কামতাভাষী, কামতা সংস্কৃতি সম্পন্ন খেটে খাওয়া মানুষেরা; শহরের শিক্ষিত সংস্কৃতি প্রেমী, আঈ ভাষা প্রেমী মানুষেরা।

2. মাটির প্রতি বন্চনা 

মাটির প্রতি বন্চনার লিস্টও কম নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উত্তরের জেলাগুলির সঙ্গে কলিকাতার সরাসরি রেল যোগাযোগই ছিলনা। আগে কলিকাতা যেতে হলে ফারাক্কা পর্যন্ত ট্রেনে যেতে হত সেখান থেকে স্টিমার এ করে নদী পেড়িয়ে ওপার থেকে আবার ট্রেন ধরতে হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোটামুটি 20 বছর পর্যন্ত এই ভাবে যেতে হত। তারপরে ফারাক্কায় ব্যারেজ হওয়ার পর সরাসরি ট্রেন চলা শুরু হয়েছিল। এখোনো কামতাভুমিতে কোনো জাতীয় মাপের হাসপাতাল নেই। এখানকার বেশীরভাগ রোগী হয় কলিকাতা নয়ত ভেলোর, বাঙ্গালোর যায় ডাক্তার দেখাতে বা অপারেশন করাতে। AIIMS হাসপাতাল যেটা রায়গঞ্জে হওয়ার কথা ছিল সেটাও কলিকাতা পরিচালিত সরকার ও প্রশাসন কায়দা করে কলিকাতার কাছেই কল্যানীতে নিয়ে চলে গেছে। আর এখানকার নেতৃবৃন্দ আনুগত্য দেখাতে ব্যস্ত। 

কয়েক বছর আগেও মাত্র একটা বিশ্ব বিদ্যালয় ছিল তাও শুধুমাত্র ভারতের উদ্বাস্তু নগরী শিলিগুড়িতে। 

করোনা মহামারীতে এখানে টেস্টিং ফ্যসিলিটি আসে সব থেকে পড়ে। কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলা সবার আগে তারপরে যদি বেচে থাকে তাহলে কামতাভুমিতে। 
ন্যাশনাল লেবেলের কোনো ল্যাবরেটরি নেই এখানে। হবে কি করে? কেন্দ্র সরকার থেকে যদিও বা কোনো প্রস্তাব আসে, কলিকাতা প্রশাসন সান্টিং করে দেয় কলিকাতার আশে পাশে। চা বাগান এখানে আর টি কমিশনের হেড অফিস কলিকাতায়। টুরিজম এখানে আর হেড অফিস কলিকাতায়। উত্তরের এক বিশেষ বাংলা প্রিন্ট মিডিয়া তার লেখনী বা খবর প্রকাশন এমনি যে তার শুধু বডি এখানে আর আত্মা কলিকাতায় মনে হয়। যদিও দাবী করে “আত্মার আত্মীয়“। আমাদের এটা বুঝে নিতে হবে সেই মিডিয়া কোন আত্মার আত্মীয়।

 ব্যবসার ক্ষেত্রে যেকোনো লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন পেতে গেলে অন্তত কয়েকবার কলিকাতা ছুটতে হবে অতিরিক্ত পরিবহন খরচা করে। ছাত্র ছাত্রীদের লিখিত পরীক্ষার সিটও নাকি অনেক ক্ষেত্রে কলিকাতার কোনো এক কলেজে পড়ে। ট্রেন টিকিট বা বাস টিকিট না পাওয়ার জন্য পরীক্ষা যে মিস হবেনা তার গ্যারান্টি কে দেবে? লিখিত পরীক্ষা পাশ করার পরে ভাইবা ভসি সেটাও কলিকাতায় গিয়ে দিতে হবে অতিরিক্ত বাস বা ট্রেন ভাড়া খরচা করে। UPSC পরীক্ষার জন্য কামতাভুমিতে এখোনো সেরকম কোনো কোচিং সেন্টারই নেই। 70 বছর পাড় হয়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়ে। কামতাপুরী আন্দোলন ও গ্রেটার আন্দোলন করে কত মায়ের কোল খালি হয়ে গেছে। কত তরতাজা যুবকের প্রাণের কোনো হদিসই মিলেনি। সেই ঐতিহাসিক সুবর্ণ ভুমি এখোনো অন্ধকারে নিমজ্জিত। তোর্ষা, তিস্তা, মহানন্দার জল পাহাড় থেকে প্রকৃতির নিয়মে সাগরে আবার সাগর থেকে বাস্পীভুত হয়ে পাহাড়ে এসে ধাক্কা খেতে খেতে হয়ত বিরক্ত হয়ে গেছে, অধীর আগ্রহে আছে কবে প্রভাতে টাইগার হিলে সেই নতুন সূর্যের মুখ দেখবে যেদিন হিমালয়ের সন্নিকট পাদদেশ তথা ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা-মহানন্দার অববাহিকা অন্চলে থাকবে না কোনো বন্চনার কালোমেঘ। 


# Deprived Kamtabhumi, Deprived Political Leader, Deprived People, Uttarbanga deprived