ভাষার নাম নিয়ে দ্বিচারিতা / Nomenclature of Kamatapuri Language
আজকে সাধারণ কোচ রাজবংশী কামতাপুরী মানুষেরা অধীর আগ্রহে আছে যাতে তাদের মাওয়ের ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষাকে সরকার স্বীকৃতি দেয়, তাদের ছেলে মেয়েরা যাতে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের সুযোগ পায়। কিন্ত বাধ সেধেছে একই ভাষার দুই নামে দুটো আলাদা আলাদা অ্যাকাডেমি। এক হল রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি আর এক হল কামতাপুরী ভাষা অ্যাকাডেমি । রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি গঠন করেছে বর্তমান তৃণমূল সরকার যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিল প্রাক্তন জলপাইগুড়ির সাংসদ মাননীয় বিজয় চন্দ্র বর্মন। 2012 সালে যখন প্রথম রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি গঠন হয় তখন তার চেয়ারম্যান ছিলেন সাংসদ বিজয় চন্দ্র বর্মন এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে ডঃ গিরিজাশঙ্কর রায় বর্তমানে রয়েছেন। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন ডঃ নিখিলেশ রায়, ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ বর্মন ও আরো অনেকে।
ভাষার নাম নিয়ে সংবেদনশীলতার অভাব
এদিকে কামতাপুরী ভাষার ( একই ভাষা যার নাম পরিবর্তন করে রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি দিয়েছে) জন্যে আন্দোলন দীর্ঘদিনের, তৃণমূল পার্টির জন্মেরও (1998 সাল) আগের থেকে এই নামে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষের আত্মত্যাগ ও বলিদান ছিল যাতে কামতাপুরী ভাষা স্বীকৃতি পায় ও অন্ততপক্ষে প্রাথমিক স্তরে পঠন পাঠন চালু হয়।
কামতাপুরী ভাষা নামে ভাষা আন্দোলনের জন্য অনেক যুবক শহীদও হয়েছেন অতীতে, অনেকের ঘরবাড়ি, সংসার ছাড়খাড় হয়েছে। এবার প্রশ্ন হল যখন কামতাপুরী ভাষা নামে আন্দোলন আগের থেকেই চলছিল, সংবিধানের অষ্টম তফসিল এ ওয়েটিং লিস্টেও আছে। তাহলে একই ভাষার সেই নাম না নিয়ে রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি নামে অ্যাকাডেমি করার কি যৌক্তিকতা।
রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি নামে অ্যাকাডেমি বানানোর যাদের অগ্রনী ভূমিকা ছিল তারা হলেন ডঃ গিরিজাশঙ্কর রায়, প্রাক্তন সাংসদ বিজয় চন্দ্র বর্মন, ডঃ নিখিলেশ রায় প্রমুখ। আশ্চর্যের বিষয় হল এনারাই 2004 সালের জুন মাসে রাজবংশী ক্ষত্রিয় কনফেডারেশনের এক অনুষ্ঠানে কামতাপুরী ভাষায় যাতে পঠনপাঠন চালু হয় সেই দাবি রেখেছেন। সেই সময় কিন্তু রাজবংশী ভাষা নামে কোনো দাবী দাওয়া ছিলনা। যারা যারা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের নামগুলো একটু উল্লেখ করি –
শ্রী মনিভূষণ রায় ( প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক), শ্রী মতীন্দ্র প্রকাশ রায় ( সংগঠন -সভাপতি ), দূর্গা রায় ( সংগীত পরিবেশক ) , ড:নিখিলেশ রায় ( অনুষ্ঠান সঞ্চালক ) , শ্রী যোগেশ চন্দ্র বর্মণ ( প্রধান অতিথি, বন মন্ত্রী, প: সরকার ), ড: গিরিজাশঙ্কর রায় ( অধ্যাপক), ড: সুখবিলাস বর্মা, ড: দ্বিজেন ভগত, শ্রী ধর্মনারায়ণ বর্মা ( প্রাক্তন শিক্ষক/ ভাষা পন্ডিৎ) , শ্রী মনমোহন রায়, শ্রী হরিমোহন বর্মণ। ( প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক), শ্রী চন্দ্রকিশোর রায় ( সভাপতি, অভ্যর্থনা কমিটি ), শ্রী বিজয় চন্দ্র বর্মণ ( সংগঠন , সম্পাদক ), শ্রী তরণীকান্ত বর্মণ ( সমাজ সেবক ) , পঞ্চানন মল্লিক ( সমাজ সেবক ), শ্রী মনোজ রাউত ( সাংবাদিক) , শ্রী শরৎ চন্দ্র রায়, শ্রী গিরীন্দ্রনাথ বর্মণ ।
মাননীয় ধর্মনারায়ণ বর্মা ভাষার নাম কামতাপুরী ভাষা পরিবর্তন করে রাজবংশী ভাষা হোক বা অ্যাকাডেমি হোক এর পক্ষপাতি ছিলেন না। উপরের নামগুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে মাননীয় বিজয় চন্দ্র বর্মন, ডঃ গিরিজাশঙ্কর রায়, ডঃ নিখিলেশ রায়, ডঃ দ্বীজেন্দ্র ভকত, ড: সুখবিলাস বর্মা এনারা 2004 সালে কামতাপুরী ভাষায় পঠন পাঠন চালু হোক এই দাবী থেকে সরে এসে 2004 থেকে 2012 এই 8 (আট) বছরে নতুন নাম রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি বানিয়ে ফেললেন। আর যারা কামতাপুরী ভাষা আন্দোলনের সাথে প্রথম থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তাদের আন্দোলনের কি কোনো মূল্য নেই?
পরবর্তীতে তৃণমূল সরকার রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমির সাথে সাথে কামতাপুরী ভাষা অ্যাকাডেমিও (2017 সাল) বানিয়ে দিলেন যেটা প্রথমেই বানিয়ে দিলে আর রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি বানানোর দরকার হতনা। একই ভাষার দুই নামে দুটো অ্যাকাডেমি কখনোই চলতে পারেনা। এটা অনৈতিক, সাধারণ ভাষা প্রেমী মানুষদের সাথে সাথে তাদের মাতৃভাষার চরম অবমাননা করা। এখানে যারা প্রথমে কামতাপুরী ভাষা অ্যাকাডেমির দাবীদার থেকে পরবর্তীতে রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি বানিয়ে দেওয়ার পক্ষ নিলেন এবং ক্ষমতা বলে বানিয়েও দিলেন , তারা এবং বর্তমান তৃণমূল সরকার উভয়েই দোষী; সাধারণ ভাষা প্রেমী মানুষ এতে অপমানিত ও অসহায়ও বটে। আপনাদের কাছে সাধারণ মানুষ এটাই চায় যে এক নামে একটাই ভাষা অ্যাকাডেমি হোক, দুটো আলাদা আলাদা নামে নয়।
এবার একটু অন্য কথায় আসা যাক। যারা প্রথমে কামতাপুরী ভাষা অ্যাকাডেমি জন্যে রাজবংশী ক্ষত্রিয় কনফেডারেশনের মন্চ আলোকিত করেছেন 2004 সালে উনারা 8 বছরের মধ্যে কি করে সেই নাম বর্জন করে রাজবংশী ভাষা নাম গ্রহন করে সেটাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগলেন এবং 2012 সালে তার বাস্তব রুপও দিলেন। এটা কি স্বেচ্ছায় না অদৃশ্য কোনো চাপ বা প্রলোভন কাজ করেছে। এখানে কেউ ভাষাবিদ দিয়ে যুক্তি দেখাতে আসবে না আশাকরি। কারণ কয়েক বছরের ব্যবধানে একই ভাষার দুই অ্যাকাডেমি বানানোর ক্ষেত্রে ভাষাবিদদের কোনো ঔষুধ কাজ করেনি। রাজনীতির ক্ষেত্রে পুলিশ, জেলাশাসক, ফরেন্সিক রিপোর্ট, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, ভাষাবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ সবাই ফেইল করে, সবকিছুই ফেইল করে প্রয়োজন বিশেষে।
মাননীয় ডঃ গিরিজাশঙ্কর রায়, মাননীয় বিজয় চন্দ্র বর্মন, ডঃ নিখিলেশ রায়, ডঃ দ্বীজেন্দ্র ভকত মহাশয় আপনারাই এর উত্তর দিন। কেন আপনারা একসময় কামতাপুরী ভাষার পঠনপাঠন চেয়ে একই ভাষার অন্য নাম রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি বানানোর জন্য উঠে পরে লাগলেন। আপনারা জানেন ভাষা আন্দোলন কামতাপুরী ভাষা নামে হয়েছিল, রাজবংশী ভাষা নামে নয়। যদি রাজবংশী ভাষা নামে আন্দোলন হত তাহলে কোনো ব্যাপার ছিলনা বা আজকের দিনে সাধারণ মানুষকে এতটা অসহায় হতে হতনা। এই ভাষায় রাজবংশী মানুষের সাথে সাথে, দেশী মুসলিম সমাজ, নাথ যোগী সহ আরো অনেক অরাজবংশী মানুষ কথা বলে এটা আমরা সবাই জানি।
আর একটা কথা যেটা না বললেই নয়। 2012 সালে রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি বানানোর পর সেরকম ভাবে কোনো কাজকর্মই হয়নি। মাননীয় বংশীবদন বাবুও (GCPA) ওনার রাজনৈতিক জীবনে ভাষা নিয়ে বা ভাষার নাম নিয়ে কোনো আন্দোলন করেননি। কিন্তু 2017 সালে কামতাপুরী ভাষা অ্যাকাডেমি বানানোর পরে পরেই 2018 সালে বংশীবদন বাবুকে রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান বানিয়ে দেওয়া হল। আর উনিও জানিনা কেন সেই পদ গ্রহণ করলেন? ভাষা আন্দোলনে যেখানে ওনার কোনো ভুমিকাই নেই সেখানে কেন তিনি রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমির যা বর্তমান তৃণমূল সরকার কর্তৃক সৃষ্ট চেয়ারম্যান হিসাবে অধিষ্ঠিত হবেন। এখানে ওনার রাজনৈতিক আদর্শও প্রশ্নের মুখে। সাধারণ ভাষা প্রেমী মানুষ কোন গ্যারান্টিতে ওনাকে বিশ্বাস করবে।
আজ মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে একটা কথা বলাই বাহুল্য, শিক্ষার সাথে সাথে মানুষের চরিত্রগত উন্নয়ন এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা বড় জরুরি। কিছু মানুষকে ব্যক্তিগত সুবিধা পাইয়ে দিয়ে আপামর জনসাধারণের মুখের ভাষা প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধ আচরণ করে বা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করার পিছনে বর্তমান তৃণমূল সরকারের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ যার ফল আসন্ন 2021 বিধানসভার ভোটে প্রভাব ফেললেও ফেলতে পারে।